Adsense

Hajrat SahMukhdum Ruposh (R)

ফেরিওয়ালা সংগৃহীত
হযরত মখদুম শাহ (রহঃ) এর জীবনীঃ

 ইতিহাস বলে - পুর্ব বাংলায় কোন নবী রাসূল আসেন নি ইসলামের অমীয় বানী প্রচার করতে। কিন্তূ,  যাদের পবিত্র পদধুলিতে বাংলার মাটি নূরের আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছে তারা হলেন পীর, আউলিয়ায়েকেরাম। তাদের উদারতা, মহত্ত্ব, মহানুভবতা এ দেশের মানুষকে করেছে মুগ্ধ। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শোষিত ও নির্যাতিত মানুষেরা দলে দলে ইসলাম এর পতাকাতলে আশ্রয় নিয়ে শান্তি আর সমৃদ্ধির সন্ধান পায়। হজরত শাহ মখদুম (রহঃ) ছিলেন ঐ সকল আউলিয়া, পীর দের মধ্যে অন্যতম। তার আগমনে উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে ইসলামের বিস্তৃতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। হযরত মখদুম শাহ (রহঃ) ছিলেন বড়পীর হজরত আব্দুর কাদের জিলানী (রহঃ) এর নাতি, উনার মাজার শরীফ রাজশাহী জেলার দরগাপাড়ায় অবস্থিত (পদ্মার তীরে এবং রাজশাহী কলেজের পশ্চিম পাশে )। শাহ মখদুম (রহঃ) এর প্রকৃত নাম আব্দুল কুদ্দুস। তিনি সুদূর বাগদাদ শহর থেকে ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে হিজরি ৬৮৫ সনে এদেশে তার আগমন ঘটে।

অবদান: 
        আজ রাজশাহী অঞ্চলে মুসলমান দের যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার পটভুমিতে শাহ মখদুম (রহঃ) এর অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। তার ইসলাম প্রচারের এ অবদান এর জন্যে বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন উপাধি তে ভুষিত হয়েছেন। ইসলাম প্রচারের এ অবদান এর জন্য 'শাহ', 'মখদুম', 'রুপোশ' প্রভৃতি উপাধিতে তিনি ভুষিত হন। প্রাচীন বরেন্দ্র এবং গৌড় অঞ্চলে ইসলামের ভিত কে শক্তিশালী করতে তার মুখ্য ভূমিকা রয়েছে।
শান্তি ও কামিয়াবির চলার পথে সাহায্যের জন্য হুজুরে পাক (সঃ) এর পরও যুগে যুগে বহু পীর অলি আওলিয়া এসেছেন, যাঁরা ছিলেন সংসার ত্যাগী, সংগ্রাম করেছেন অন্যায় আর অসত্যের বিরুদ্ধে এবং এ পৃথিবীতে করেছেন সত্য প্রতিষ্ঠা। এ ব্রত নিয়েই হযরত শাহ্‌ মখদূম রুপোশ (রহঃ) এদেশে এসে ছিলেন সুদুর বাগদাদ থেকে। ‘রুপোশ’ শব্দটি ফার্সী শব্দ। এর অর্থ মুখ আবরণকারী ব্যক্তি। এটি তার উপাধি ছিল। তার আসল নাম ছিল সৈয়দ আব্দুল কুদ্দুস। তিনি শিক্ষা লাভ করে বিদ্যাসাগর, বিদ্যাবিশারদ হন এবং মহাবুযূর্গী লাভ করে মখদুম শাহ্‌ রুপোশ “কুদ্দুশা শারাহ্‌” নামে অভিহিত হন। ‘কুদ্দুশা শারাহ’ মানে চিরস্থায়ী হোক তার রহস্য। তিনি ৬১৫ হিজরীল ২রা রজব বাগদাদ শরীফে জন্ম গ্রহণ করেন।

শাহ মখদুম (রহঃ) এর জন্ম ও বংশ পরিচিতিঃ
            হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) ছিলেন বড় পীর হযরত আবদূল কাদের জিলানী (রহঃ) এর পুত্র আজাল্লা শাহের মেজ পুত্র। সে হিসেবে বড় পীর হযরত আবদূল কাদের জিলানী (রহঃ) ছিলেন হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর দাদা। ইসলামের এক সঙ্কটময় মুহুর্তে আল্লাহর করুনায় ন্যায় ও সত্যের প্রতীক পবিত্র ইসলামের পূনরুজ্জীবনকারী মহাপুরুষ হযরত আবদুল কাদের জিলানী আল হোসেনী আল হোসায়নী (রহঃ) এর জন্ম হয়।আল্লাহ পাক হযরত আদম (আঃ) কে এক খোশ খবরী দিয়েছিলেন যে, নবুয়াতের দরজা বন্ধ হওয়ার পর পৃথিবীর বুকে তোমার এক সন্তানের জন্ম হবে। তিনি হবেন আউলিয়াকুল শ্রেষ্ঠ ও মারেফতের সর্বগুনে গুণান্বিত। সর্বাপরি তাঁর পৃষ্ঠদেশে অঙ্কিত থাকবে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর পদচিহ্ন, সে তাঁর স্বীয় প্রতিভা ও সাধনার দ্বারা পবিত্র ইসলামের গৌরব ও মহিমাকে সঞ্জীবিত করে তুলবে। তিনি হলেন বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)।আল্লাহ পাকের প্রিয় হাবীব হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) তাঁর প্রাণপ্রীয় দৌহিত্র হযরত হাসান (রাঃ) কে উদ্দেশ্যে করে বলেছিলেন, হে ভাই হাসান। আল্লাহ পাকের রহমতে তোমারই বংশে পরবর্তীকালে আগমন করবে আওলিয়াকুল শ্রেষ্ঠ এক মহাতাপস। যার নাম হবে সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী। তিনি প্রথিবীর মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবেন। তিনি যাবতীয় কাজ কর্মে, চিন্তায় ও আদর্শে উজ্জল কীর্তি স্থাপন করবেন।পরবর্তীকালে বিশ্বনবী (দঃ) এর ভবিষ্যত বানী সত্যে পরিণত হল এবং হযরত হাসান (রাঃ) বংশে গাওছুল আযম বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) জন্ম গ্রহণ করেন।শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, বিশ্ব নবী (দঃ) আল্লাহ পাকের দরবারে আরজ কে ছিলেন যে, ওগো দ্বীন দুনিয়ার মালিক, তুমি আমার সেই প্রতিনিধির উপর রহমত ও করুণা বর্ষণ কর, সে আমার পরে পৃথিবীতে আগমন করবে এবং আমার হাদীস  যথার্থ ও সঠিকভাবে বর্ণনা করবে আর আমার তরীকাকে পুনরুজ্জীবিত করে মৃত প্রায় ইসলামকে পুনঃজীবন দান করবে। বিশ্বনবী (দঃ) এর উল্লেখিত প্রতিনিধি রূপে বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর আবির্ভাব হয়েছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন।মাতৃ-পিতৃ উভয় সুত্রেই হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) ছিলেন জগদ্বিখ্যাত সৈয়দ বংশের উজ্জল জ্যেতিঙ্ক। তাঁর পুন্যবান পিতার বংশ  সুত্র উর্দ্ধতন পর্যায়ে আওলাদে রাসুল (দঃ) হযরত হাসান (রাঃ) এর সহিত মিলিত হয়েছে, অপর দিকে সতী সাধবী মাতার বংশক্রম উর্দ্ধতন পর্যায়ে মিলিত হয়েছে হযরত হোসেন (রাঃ) এর সংগে। এজন্যই তিনি ‘আল হাসানী এবং আল হোসেনী’ উভয়বিধ উপাধিতেও বিভুষিত হতেন। তাঁর আদি পিতৃপুরুষ ছিলেন হযরত আলী (রাঃ) সুতরাং পিতা এবং মাতা উভয় সুত্রেই তিনি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর সংগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বড়পীর হযরত আবদূল কাদের (রহঃ) ছিলেন হযরত শাহমখদুম (রহঃ) এর দাদা। বড়পীর সাহেবের ২৭ জন পুত্রের মধ্যে হযরত আজাল্লা শাহ ছিলেন একজন। হযরত আজাল্লা শাহের দ্বিতীয় পুত্রই হলেন হযরত শাহ্‌ মখদুম রূপোষ (রহঃ)।হযরত আজাল্লা শাহের তিন পুত্র ছিল। তাঁর অন্য দু’পুত্রের নাম ছিল সৈয়দ মুনির আহমদ (রহঃ) ও সৈয়দ আহমদ তন্নুরী (রহঃ) ছিলেন সকলের বড়। শাহ্‌ মখদুম ছিলেন মেজ এবং সৈয়দ মুনির আহমদ ছিলেন সবার ছোট। হযরত শাহ্‌ মখদুম (রঃ) এর পিতা হযরত আজাল্লাশাহও একজন বড় ওলী ছিলেন। দিল্লীর সুলতান ফিরোজমা হযরত আজাল্লা শাহের মুরীদ ছিলেন। হযরত শাহ্‌ মখদুম (রহঃ) এর পুরো পরিবারটাই ওলী ছিলেন। হুজুর আকরাম (ছঃ) এর তরীকাকে পুনরুজ্জীবিত করে দীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য পরিবারের সকল সসদ্যবৃন্দ দেশ দেশান্তরে গিয়েছেন, সকলেরই উদ্দেশ্য ছিল দ্বীন কি করে জিন্দা রাখা যায়। হুজুর আকরাশ (ছঃ) এর ঐ একই উদ্দেশ্য ছিল। পিতা ও মাতার উভয় সুত্রেই শাহ্‌ মখদুম (রাঃ)  ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুম্মদ (দঃ) এর বংশধর।

শাহ মখদুম (রহঃ) পিত্রকুলের বংশ সুত্র :
                হযরত সৈয়দ আবদূল কুদ্দুস ওরফে হযরত শাহ্‌ মখদুম রূপোশ (রহঃ) এর পিতার নাম (১) হযরত সৈয়দ আজাল্লা শাহ (রহঃ) (২) তাঁর পিতার নাম হযরত আব্দূর কাদের জিলানী (রহঃ)। তার পিতার নাম (৩) হযরত সৈয়দ আবু আব্দুল্লাহ মুসা (রহঃ)। তার পিতার নাম (৪) হযরত সৈয়দ আবু আবদুল্লাহ (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (৫) হযরত সৈয়দ ইয়াহইয়া জাহেদ (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (৬) হযরত সৈয়দ মোহাম্মদ (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (৭) হযরত সৈয়দ দাউদ (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (৮) হযরত সৈয়দ মুসা সানী (রহঃ) তাঁর পিতার নাম (৯) হযরত সৈয়দ আবদুল্লাহ সানী (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (১০) হযরত সৈয়দ মুসা আল জোহন (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (১১) হযরত সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মহজ (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (১২) হযরত সৈয়দ হাসানে মোসাল্লাহ (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (১২) হযরত সৈয়দ হাসানে মোসাল্লাহ (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (১৩) হযরত সৈয়দ হাসান (রহঃ), তাঁর পিতার নাম (১৪) শেরে খোদা হযরত আলী মোর্তজা (রহঃ), আল্লাহ পাক তাঁদের উপর রহমত করম দান করুন। হযরত শাহ্‌ মখদুম (রহঃ) এর মাতৃকুলের বংশ সূত্র বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর  মতই। এইক্ষেত্রে লক্ষনীয় বিষয় হল যে, হযরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর পিতৃকুলের দ্বাদশতম সুত্র এবং মাতৃকুলের চতুদর্র্শতম সুত্র হযরত আলী মোর্তজা (রাঃ) এর সহিত মিলিত হয়েছে। শাহ মখদুম (রহঃ) এর পুরো পরিবারটাই ওলী দরবেশ ছিলেন এবং দ্বীন প্রচারের জন্য দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েন। শাহ্‌ মখদুম (রহঃ) এর বড় ভাই হযরত সৈয়দ আহমদ তন্নুরী বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর কাছ থেকে স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশেই দিল্লী থেকে কতিপয় অনুচর সহ বাংলাদেশের পানডুয়া এলকায় আসেন। পরে পানডুয়া থেকে পৌত্তলিকতা ধ্বংশ করতে করতে নোয়াখালী জেলায় হাজির হন এবং সেখানে স্থায়ী আস্তানা স্থাপন করেন। এ সাধকের মাযার শরীফ নোয়াখালী অবস্থিত।

হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর এদেশে আগমন ও আগমনের উদ্দেশ্য :
  হযরত মিরান শাহ (রহঃ) এবং সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস (রহঃ) বিভিন্ন অবিচার অনাচার দুর করে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ শরীফ থেকে এ দেশে আসেন ৬৮৫ হিজরী সনে। হযরত মিরান শাহ্‌ তাঁর অনুচর সহ কাঞ্চনপুরে আস্তানা গাড়েন। হযরত আবদূল কুদ্দুস (রহঃ) নোয়াখালী জেলায় রামগঞ্জে অবস্থিত শ্যামপুরে আস্তানা গাড়েন। দু’বছর অধিক কাল শ্যামপুর এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে দ্বীন ইসলাম প্রচার করেন। পরে তিনি তাঁর মুরীদ হযরত সৈয়দ জকিম উদ্দীন হোসেনী (রহঃ) কে শ্যামপুর মোকামের খলিফা নিযুক্ত করেন। রামপুর বোয়ালিয়ায় হযরত তুরকান শাহের শহীদ হওয়ার সংবাদ শুনে দানবকুলকে ধ্বংশ করার উদ্দেশ্য চারজন কামেল দরবেশ সহ কুমির বাহনে নদীবক্ষে বোয়ালিয়া অভিমুখে যাত্রা করেন। হযরত দিলাল বোখারী (রহঃ), হযরত সৈয়দ আব্বাস (রহঃ), হযরত সুলতান শাহ্‌ (রহঃ) ও হযরত করম আলী শাহ (রহঃ) দরবেশের সংগী হন। শাহ মখদুম এদেশে এসে বাঘা নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে পদ্মা নদীর নিকটস্থ যে কেল্লা স্থাপিত করেছিলেন উহাই মখদুম নগর নামে খ্যাত। মখদুম নগর রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার অন্তর্গত। বর্তমানে এটি বাঘা শরীফ বা কসবে বাঘা নামে পরিচিত।গৌড় নগরের বাদশা হোসেন শাহের পুত্র নছবত শাহ দেশ পর্যটনকালে বিখ্যাত মখদুম নগরে উঠে সমস্ত শুনে ৯৩০ হিজরীতে একটি দীঘি খনন ও কারুকার্য খচিত প্রকান্ড মসজিদ নির্মান করে দেন। তৎপর দিল্লীর বাদশা জাহাঙ্গীরের পুত্র শাহজাহানের পরিভ্রণকালে তিনি বিখ্যাত মখদুম নগর পরিদর্শন করেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর ভ্রমন রোয়েদাদ অনুসারে ঐ মসজিদ আদির কীর্তি রক্ষার্থে ও ধর্ম কার্যের জন্য ৪২টি মৌজা দান করেন এবং ঐ সবের তদবীর তদারক ও দেখাশুনার জন্য ঐ নগরে কিছু লোক লস্কর রেকে আল্লাবকস বরখোরদারকে লস্কর প্রধান নিযুক্ত করেন। শাহ মখদুম (রহঃ) এর আগমনের সময় রাজশাহী শহরের নাম ছিল ‘মহাকালগড়’। তবে পরে এ নাম রামপুর বোয়ালিয়াতে রূপান্তরিত হয়।

হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর আগমনঃ
 রামপুর বোয়ালিয়া ( বর্তমানে দরগাপাড়া নামে পরিচিত) কে পূর্বে মহাকালগড় বলা হত। এ স্থানে বহু রকমের দেও এর প্রতিমুর্তি ও বহু মঠ-মন্দির পূর্ন ছিল।  এখানে মহাকাল দীঘি নামে একটা প্রকান্ড দীঘি ছিল। এখানে ৩০/৪০ বিঘা জমির উপর দেও রাজার বাড়ী ছিল। তৎকালিন দৈত্য ধর্মালম্বিদিগের প্রধান তীর্থ স্থান ছিল এ রামপুর বোয়ালিয়া। তাদের ধর্মমতে এখানে এসে নরবলি দিত। অনেক সময় লোক মানূষ খরিদ করে আনত। কখনও আবার জোর করে ধরে আনত। অনেকে আবার আসত স্বেচ্ছায়। কাহারও সনতান না হলে মানত করত যে সন্তান হলে একট বলি দেবে। এখানে দু’জন দেওরাজা ছিল তাদেরকে মানুষ ঈশ্বরের অবতার বলে বিশ্বাস করত।কয়েকজন মুসলমান দরবেশ এ অঞ্চলে আসলে তাদেরকে ধরে বলি দেওয়া হয়। এ সংবাদ বাগদাদ শরীফে পৌছালে পীরানে পীর দস্তগীর দপ্তর হতে হযরত তুরকান শাহকে রামপুর বোয়ালিয়াতে ধর্ম প্রচারের জন্য পাঠানো হয়। তিনি কিছু অনুচর সহ এ স্থানে পৌছলে এবং ধর্ম প্রচার শুরু করলে দেও রাজের সাথে সংঘর্ষ বাধে এবং তুরকান শাহ তাঁর হাতের লাঠি দ্বারা বহু দেও ধর্মালম্বির প্রাণ নাশ করেন। ফলে জীবন্ত অবস্থায় এ ফকিরকে বেধেঁ আনার আদেশ হয়। রাত্রিকালে এ ফকিরকে বেধেঁ ফেলা হয়। কিন’ শত শত লোক চেষ্টা করেও হযরত তুরকান শাহকে তাঁর গদী হতে সরাতে পারেনি।  শেষ পর্যন্ত ঐ স্থানেই তাঁকে ৬৭৭ হিঃ সনে হত্যা করা হয়। কিন্তু লাশ হস্তী লাগিয়ে বিন্দু মাত্র স্থানান্তর করতে না পেরে ঐ স্থানেই তাকে পুঁতে রাখা হয়। আজও উক্ত স্থান বর্তমানে দরগাপাড়ায় তুরকান শহীদের আস্তানা নামে খ্যাত।রামপুর বোয়ালিয়ায় হযরত তুরকান শাহের শহীদ হওয়ার সংবাদ শুনে হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) দানবকুলকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য এখানে আসেন। তিনি কিছু সংগীসহ নদী পথে কুমীরের পিঠে চড়ে এসে চারঘাট থানার বাঘা নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে পদ্মা নদীর তীরে কেল্লা স্থাপন করেন এবং উক্ত স্থানই মখদুম নগর নামে পরিচিত।তাঁর নির্মিত মখদুম নগরের এ দুর্গ থেকে তিনি অভিযান চালিয়ে মহাকালগড় দেও রাজ্য জয় করেন। আধ্যাতিক শক্তি বলে তিনি যাদুকুন্ড ধবংশ করেন। এখান থেকে দেও রাজার বিরূদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।

এক নাপিতের গল্পঃ
রামপুর বোয়ালিয়ায় এক নাপিতের তিন পুত্র ছিল। তার দু’পুত্রকে নরবলি দেওয়া হয় এবং শেষ পুত্রকেও বলি দেয়ার সিদ্ধান্ত হলে সে মখদুম নগরে উপস্থিত হয়ে হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর নিকট নালিশ পেশ ‘করলে  তিনি বললেন, “যাও তুমি তোমার সন্তানসহ নদীর ধারে অবস্থান করগে আমার সাক্ষাৎ পাবে। “নাপিত দম্পত্তি সন্তান সহ দিবা রাত্রি নদীর ধারে ধারে কেঁদে বেড়ায়। কিন্তু তারা শাহ মখদুমের দর্শন না পেয়ে সন্তানসহ পানিতে ডুবে মরার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পানির মধ্যে নামতে থাকে। এমন সময় পদ্মা গর্ভে “ভয় নেই ভয় নেই” বলে কুমীর বাহনে মখদুম (রহঃ) নাপিত দম্পতির নিকট আবিভূর্ত হলেন। তাদের অভয় দিয়ে পুত্রের গলদেশে পাক হস্ত বুলিয়ে দিলেন এবং ফুঁ দিলেন আর বলিলেন, “শীঘ্রই দেও রাজ্য ধ্বংশ হয়ে যাবে। তোমার পুত্রের বলি হবে না। কোন কথা প্রকাশ করো না।” এসব বলে সাধক কুমিরের পিঠে আবরা ফিরে গেলেন। সকাল বেলা দেও মন্দিরে নাপিত পুত্রকে আনা হল । খাড়ার ঘাত প্রতিঘাতেও নাপিত পুত্রকে কাটা গেল না। সে কোনরূপ কষ্ট বোধও করল না। দেও রাজের নিকট ঐ সংবাদ দেয়া হল। সব শুনে তিনি বললেন যে, ঐ নরে দোষ আছে। ওকে ছেড়ে দাও। নরবলি দেবার কাজে ব্যবহৃত পাথরটি আজও সাধকের মাযার প্রাঙ্গণে সংরক্ষিত আছে।

মহাকাল গড়ের যুদ্ধঃ
 হযরত তুরকান শাহ ও অন্যান্য মুসলমানদের হত্যার প্রতিবাদ এবং সমাজ থেকে অনাচার অত্যাচার দুর করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য শাহ্‌ মখদুম (রহঃ) কে তিন তিন বার দেও রাজার সাথে যুদ্ধ করতে হয়।প্রথম বারে তিনি তার লোকজন নিয়ে দেও রাজপ্রসাদ ঘিরে রাখেন। দেও ধর্মালম্বীগণ সমবেত হয়ে যুদ্ধ করে অনেক দেও ধর্মালম্বী মারা গেল। শাহ মখদুম (রহঃ) এর পক্ষেও কিছু লোক শহীদ হলেন। শেষ দিনের যুদ্ধে দরবেশগণের কিছু ঘোড়া শহীদ হল। যেখানে ঘোড়া শহীদ হয় উক্ত স্থানটি ঘোড়ামারা নামে খ্যাত। রাজশাহী শহরের ঘোড়ামারায় বর্তমানে একটা পোষ্ট অফিস রয়েছে। দৈত্য ধর্মালম্বীগণ বুঝতে পারল এ দরবেশগণকে না তাড়াতে পারলে তাদের কোন শান্তি নেই। তাই তারা দিক দিগন্তে সংবাদ পাঠিয়ে যুদ্ধের প্রসত্তুতি নিতে লাগল। হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) ধ্যানে উহা জানতে পেরে তাদের প্রতিরোধের জন্য স্থানে স্থানে ফকির দরবেশ মোতায়েন করলেন এবং নিজেও এ যু্‌দ্ধ শরীক হলেন। বহু দৈত্য ধর্মলম্বী ধরাশায়ী হল। কিছু সংখ্যাক পালিয়ে গেল, মঠ মন্দির ভেঙ্গেচুরে লুট হল। যাদুর কুন্ডের দ্বারা দৈত্য ধর্মলম্বীগণ কোন ফল পেল না। কেননা হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) পূর্বেই তা তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি দ্বারা নষ্ট করে রেখেছিলেন। মঠ মন্দিরের সে বড় বড় পাথর ও পাথর মুর্তি আজও রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। লোকজন সেগুলি বসা ও শোয়ার  আসন হিসাবে নানাবিধ কাজে ব্যবহার করে আসছে। দৈত্য রাজ সপরিবারে পালিয়ে জীবন রক্ষা করল। মহাকাল গড়ের যুদ্ধের শহীদদের কবর মখদুম মাযার প্রাঙ্গণে আজও বিদ্যমান যা সে যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। মখদুম (রহঃ) বিজয়ীর বেশে মখদুম নগরে ফিরে গেলেন। এ শুভ সাংবাদে মখদুম নগরে আল্লাহ ও রাছুলের জয়ধ্বনী পড়ে গেল। এ বিজয়ের স্মৃতি রক্ষার্থে দ্বীন ইসলামের নামে ৭২৬ হিজরীতে এক প্রকান্ড ও অতি উচ্চ বিজয়ী সদর দরজা প্রসত্তত করা হল। ঐ দরজার পাথর ফলকে সে বৃত্তান্ত লেখা ছিল। এ তোরনের ধংসাবশেষ কালের সাক্ষী হয়ে আজও মখদুম নগরে পদ্মার তীরে বিদ্যমান রয়েছে।বনবাসী দৈত্য রাজের নিকট পলাতক দৈত্য ধর্মলম্বীগন পুনরায় সমবেত হয়ে রাজ আজ্ঞায় জয়ের আশীর্বাদ গ্রহনে তীর্থস্থান উদ্ধার কল্পে রামপুর বোয়ালিয়াতে উপস্থিত হওয়ার সংবাদ পেয়ে শাহ মখদুম (রহঃ) পুনরায় রামপুর বোয়ালিয়ায় আগমন করলেন এবং সমবেত দৈত্য ধর্মলম্বীদের মধ্যে তাঁর পাক পা হাতে এক পাট খড়ম ছুড়ে মারলেন। হু হুংকার রবে বিঘুর্নিত খড়মের আঘাতে বহু শত্রু ধরাশায়ী হল এবং কতক পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল। ওদিকে দৈত্য রাজের দু পুত্রই মুখে রক্ত উঠে মারা গেল। দৈত্যরাজ ঘটনা উপলদ্ধি করতে পেরে মৃত পুত্রদয়ের লাশ নিয়ে এসে শাহ মখদুম (রহঃ) এর পায়ে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করল। তিনি তখন মৃতলাশ দ্বয়ের হাত ধরে বললেন, ঘুমাও মাত উঠ। পুত্রদ্বয় উঠে বসল। দৈত্য রাজদ্বয় স্বপরিজনে ঈমান এনে মুসলমান হল। ইহা দেখে দৈত্য ধর্মলম্বীগণ দলে দলে মুসলমান হল। মহাকালগড় দেও মন্দির স্থানেই শাহ মখদুম (রহঃ) এর আস্তানা স্থাপিত হল। শাহ মখদুম (রহঃ) পানি পথে কুমির বাহনে, শূন্যপথে বসবার পীড়ি আসন বাহনে এবং স্থল পথে সিংহ বা বাঘ বাহনে চলাফেরা করতেন। তাঁর এ অলৌকিক ঘটনা, বোজর্গী, কেরামতী এবং অখন্ডন দোয়া ও বরদোয়া ইত্যাদি দেখে শুনে প্রায় সবাই ঈমান আনল।

হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর ওফাত বরন এবং ওসিয়াতঃ
এই মহা সাধকের কেরামতি আদেশে হঠাৎ মখদুম নগর হতে দরবেশগণ মখদুম সদনে এসে উপস্থিত হলেন। তাদের মধ্যে হতে শাহ জলিল ও শাহ নিয়ামতকে এখানকার খাদেম পদে এবং শাহ আব্বাসকে মখদুম নগরের খলিফা পদে নিযুক্ত করে তাঁদের নিকট মখদুম (রহঃ) গুপ্তভেদ ও ভবিষ্যৎ ব্যক্ত করে অছিয়ত প্রদান করলেন্‌ যে, “আমার ভ্রাতার বংশের সন্তান শাহ নুর বাগদাদ শরীফ হতে আসবেন এবং তিনিই এখানকার খলিফা পদ পাবেন। তিনি ভিন্ন অন্য কেহ খলিফা পদ পাবেন না এবং পাবার যোগ্যও নন। শাহ নুরের আসন নিয়ত আমার ডান পাশে থাকবে। তিনি সসম্মানে ভুষিত হবেন।মহাকালগড় বিজয়ের মাত্র পাঁচ বছর পরই হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) ৭৩১ হিজরীতে ২৭শে রজব ওফাত পান। মহাকালগড় মন্দির প্রাঙ্গনে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে রাজশাহী কলেজের খেলার মাঠে রূপান্তরিত হয়েছে। আস্তানার কিছু অংশ পরবর্তীকালে কীর্তিনাশা পদ্মার বুকে বিলীন হয়েছে বলে জানা যায়।

শাহ মখদুম (রহঃ) এর কুমির ও বাঘঃ
 শাহ মখদুম (রহঃ) এর রেখে যাওয়া স্মৃতির মধ্যে দুটি কুমির ও দুটি মেটে রঙ্গের বাঘ ছিল অন্যতম। কুমির দুটি ‘বোঁচা-বুচি’ নামে পরিচিত ছিল। অন্যান্য খাদেমগনের মতই দরগাহে তাদেরও বিশেষ মর্যাদা ছিল। শাহ মখদুম (রহঃ) এর বাহন এ বিরাট কুমির দুটি তার সঙ্গেই আনা হয়েছিল। তারা মহাকাল দীঘিতে থাকত। নাম ধরে ডাকলে উঠে আসত। প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে থাকতে থাকতে প্রায় গৃহপালিত পশুর ন্যায় হয়ে গিয়েছিল। অনেক ছেলে-পেলে তাদের পিঠে বসে খেলা করত। কিন্তু তারা কিছূ বলতো না। বাঘ দু’টি প্রতি সোমবার ও শুক্রবার রাতে আসত। ঐ বাঘ মাজার ও কবরের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করত এবং তাদের লেজের দ্বারা মাজার ঝাড়- দেয়া হয়ে যেত। তাই তাদের লেজকে মাজারের ঝাড়- বলা হত। এরূপ প্রদক্ষিণ করার পর বাঘ বসে যেত, তবে কবরের , পায়ের দিকে ছাড়া অন্য কোন দিকে কখনও বসত না। এব ঘন্টার বেশী মাজারে থাকত না। এবং বাঘ দুটিকে শের বাব্বার ও সিংহ বলা হত। বাঘ যাবার সময় মাজারের পিছনে ২/৩ রশি গিয়ে ডাক ছাড়ত ও চলে যেত। চলে গিয়ে আর ফিরে আসত না। এরা কাহারও কোন ক্ষতি করত না। তবে লোক মনে করত মাজারে গিয়ে কোনরূপ বেয়াদবী করলে তারা খেয়ে ফেলবে। এ বাঘ দুটি যে ছিল শাহ মখদুম (রহঃ) এর বাহক তাতে কোন সন্দেহ নেই। যারা এ দরগাহ খেদমত করে বুজুর্গী হাছিল করেছিলেন তাঁদের অনেকেই নাকি হযরত শাহ মখদুম ও শাহ নুরকে এ দু’বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে আসতে যেতে দেখেছেন। তাই শুক্রবার ও সোমবার রাত্রে মাজারে ভক্তদের খুব ভীড় হতো ও এখনো হয়।

No comments: