google-site-verification: google90012c42a1ba93ca.html

google-site-verification: google90012c42a1ba93ca.html

উপমহাদেশের স্থাপত্য কলা বিশ্বসেরা পর্ব ১

ফেরিওয়ালা
কল্পনার অতীত যার সম্পদ ভাণ্ডার স্বর্ণ মন্দির! যে মন্দিরের নিচের গোপন ভল্টে লুকানো আছে অকল্পনীয় এক ধন সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার! ভারতের কেরালা রাজ্যের থিরুভানানথাপুরাম শহরে অবস্থিত শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরকে বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত যত ধরণের প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী প্রতিষ্ঠান, সবচেয়ে ধনী ধর্মীয় উপাসনালয় তো বটেই।এই মন্দিরের নিচের ভূগর্ভস্থ ৮ টি ভল্টের মধ্যে রয়েছে অজস্র রকমের ধন সম্পদের সমাহার। এর মধ্যে ৩ টি ভল্ট খোলা হয় নি, তাই সেগুলোতে কী আছে তার সঠিক তালিকা নেই। অন্য পাঁচটিতে রয়েছে স্বর্ণ, হীরা, রুবি, পান্না, নীলা সহ অমূল্য সব দুর্লভ রত্ন পাথর, এসব মূল্যবান ধাতু থেকে থেকে নির্মিত রত্ন খচিত মূর্তি, অলংকার, তৈজসপত্র সহ নানা রকম দ্রব্যাদি, প্রাচীন মুদ্রা ইত্যাদি অসংখ্য রকমের মূল্যবান সম্পদরাশি। আর এই ৫টি ভল্টের সম্পদের মিলিত আর্থিক মূল্য হিসেবে করলে সেটি দাঁড়ায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার! ঐতিহাসিক বিবেচনায় যেগুলো অমূল্য। যে ভল্টগুলো খোলা হয় নি তাদের মধ্যে একটি ভল্টের সম্পদের পরিমাণের একটি ধারণা পাওয়া যায় ইতিহাসের কিছু বর্ণনা ও রেকর্ড থেকে। সেটা এখন বললে লেখার শুরুতেই মাথা ঘুরতে পারে। সেই তথ্যটি জানবেন এই লেখা থেকে আঠারো এবং উনিশ শতকে কেরালার মধ্য ও দক্ষিণ অংশ নিয়ে গঠিত ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যের শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরটি ষোল শতকে স্থাপিত হয়েছিল বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। তবে এর আগে থেকেই এখানে মন্দির থাকার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় ইতিহাসে, সে অনুসারে এর স্থাপনকাল সঠিকভাবে জানা যায় না। ট্রাভাঙ্কোর রাজ্য সৃষ্টির অনেক অনেক আগে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের মুদ্রাও রক্ষিত আছে মন্দিরের ভল্টের ভেতরে, যদিও তা পরবর্তী সময়ে নৈবদ্য হিসেবে আসতে পারে এমন ধারণাও রয়েছে। ব্রাহ্ম, মাৎস্য, বরাহ, স্কন্দ, পদ্ম, বায়ু, ও ভগবত এই পুরাণগুলোতে এবং মহাভারতে এই স্থানের মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ সালের মধ্যে রচিত প্রাচীন তামিল সাহিত্যের সঙ্গম আমল নামক সময়কালের রচনায় এই মন্দিরকে ‘স্বর্ণমন্দির’ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে এর বিপুল সম্পদের কারণে। মন্দিরের নির্মাণ সংক্রান্ত রেকর্ডে উল্লেখ আছে, কলিযুগ শুরু হবার পর দিবাকর মুনি এই মন্দিরটির নির্মাণকাজ শুরু করেন এবং এটি তৈরি হতে সময় লেগেছিল প্রায় ৯৬৪ দিন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে এই মন্দিরের নাম স্বর্ণ মন্দির হবার কারণ, নির্মাণের সময় থেকেই এটি বিপুল পরিমাণে সম্পদশালী ছিল। অনেক প্রাচীন তামিল সাহিত্য রচনায় এমনকি খ্রিস্টীয় নবম শতকের ভারতীয় কবিতায় এই মন্দির ও এর শহরের দেয়াল স্বর্ণনির্মিত এমন আখ্যা দেয়া হয়েছে। কোন কোন রচনায় এই মন্দিরকে অভিহিত করা হয়েছে স্বর্গ হিসেবে। আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে ট্রাভাঙ্কোরের রাজা হন আনিঝাম থুরিনাম যিনি পরিচিত মার্তণ্ড ভার্মা হিসেবে। মার্তণ্ড ভার্মা ১৭৫০ সালে ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যটি দেবতা পদ্মনাভস্বামীর পদচরণে সমর্পণের ঘোষণা দেন। তার পরবর্তী বংশধর ‘পদ্মনাভ দাস’ হিসেবে ট্রাভাঙ্কোর শাসন করবে, দেবতার নিকট এমন প্রতিশ্রুতির ঘোষণাও দেন তিনি। সেই থেকে ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবারের পুরুষ সদস্য ও রাজারা নামের আগে শ্রী পদ্মনাভ দাস উপাধি এবং নারী সদস্যরা শ্রী পদ্মনাভ সেবিনী উপাধি ধারণ করে আসছেন। ২০১১ সালে মন্দিরের এই অসাধারণ রত্নখনির আবিস্কার ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে এক জায়গা থেকেই এত পরিমাণ স্বর্ণনির্মিত দ্রব্য ও  রত্ন পাথরের সংগ্রহ আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি। দেবতা পদ্মনাভস্বামী এই মন্দিরের সমস্ত সম্পদের মালিক, এমনটাই বিশ্বাস করা হয়। মন্দিরটি পরিচালিত হয় একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে যে ট্রাস্টের প্রধান ছিল ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবার। আইনজীবী টি পি সুন্দররাজন মন্দিরের অব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি মামলা করেন। ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলার শুনানিতে নির্দেশ দেয় এই মন্দিরের ভূগর্ভস্থ ভল্টগুলোর সম্পদের তালিকা তৈরির। আর তার পর সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দির হয়ে উঠে এক মহা বিস্ময়ের নাম । মন্দির পরিচালনা কমিটি ছয়টি ভল্টের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত। মন্দিরের পশ্চিম দিকে এর ‘গর্ভগৃহ’ অর্থ্যাৎ মন্দিরের পবিত্রতম স্থান বিবেচনা করা হয় যাকে সেই দেবমূর্তি রাখার স্থানটির খুব কাছেই মাটির নিচে এই ভল্টগুলো ছিল। তথ্য সংরক্ষণের জন্য ভল্টগুলোকে ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’, ‘ই’ এবং ‘এফ’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে তালিকা তৈরি করতে গিয়ে আরও দুটো ভল্ট আবিস্কৃত হয় যাদেরকে ‘জি’ এবং ‘এইচ’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
চারটি ভল্ট, যেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সি, ডি, ই এবং এফ দিয়ে, সেগুলো ছিল মন্দিরের পুরোহিতদের দায়িত্বে। প্রতি বছর অন্তত আটবার সেই ভল্টগুলো খোলা হত। ভল্টের বিভিন্ন জিনিস মন্দিরের উৎসব ও বিশেষ আয়োজনের সময় ব্যবহার করা হত। কাজ শেষে সেগুলো আবার রেখে দেয়া হত এই চারটি ভল্টে।ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী গঠিত কমিটির সদস্যরা ২০১১ সালের ৩০ জুন মন্দিরের নিচের ভল্টগুলো খুলতে যান। সেখানে ভল্টগুলোর প্রধান প্রবেশদ্বার খুলে প্রথমে তারা ভল্ট ‘এ’ তে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভল্ট এ এর প্রবেশমুখেই তারা একটি লোহার গ্রিল দেখতে পান, সেটি খোলা হয়। এরপর আসে একটি ভারী কাঠের দরজা, সেটিও খোলা হয়। এরপর দরজাটি পেরিয়ে তারা যে স্থানে প্রবেশ করেন সেখানে মেঝেতে একটি গ্রানাইট স্ল্যাব মানে জমাটবাঁধা পাথরের স্ল্যাব দেখতে পান। সেটি সরিয়ে পাওয়া যায় পাঁচ বা ছয় ধাপের একটি সিঁড়ি। সিঁড়িটি পেরিয়ে নামার পর একটি ছোট অন্ধকার রুমে আসেন তারা। এখানেই রক্ষিত ছিল ‘এ’ ভল্টের অমূল্য সব ধন সম্পদ। সেগুলো গোটা রুম জুড়ে ছড়ানো অবস্থায় দেখেন তারা। কোনো কিছু সুন্দর করে গোছানো অবস্থায় ছিল না। ঝুড়ি, মাটি ও তামার পাত্র ভর্তি করে রাখা ছিল দামী দামী সব জিনিস। এক এক করে ভল্ট থেকে সমস্ত সম্পদ বাইরে নিয়ে এসে তালিকা প্রস্তুত করতে সময় লেগেছিল একটানা ১২ দিন। বিশ্বাস করা হয়, ‘বি’ চিহ্নিত ভল্টের মূল দরজাটি কয়েক শত বছর ধরে বন্ধই আছে। কমিটির সদস্যরা ২০১১ সালের জুলাইয়ে ভল্ট ‘বি’ তে প্রবেশের চেষ্টা করেন। প্রথমে তারা এর প্রবেশমুখে লোহার গ্রিল দেয়া দরজাটি খুলে ভেতরে ঢুকেন। এরপর দেখা যায় অত্যন্ত মজবুত ও ভারী কাঠের একটি দরজা। সেটিও খোলা হয়। এরপর আসে একটি লোহার দরজা। লোহার দরজায় গোখরো সাপের ছবি খোদাই করা আছে। ট্রাভাঙ্কোরের রাজপরিবার জানিয়েছিল, গোখরো সাপের ছবি খোদাই করা সেই দরজাটি খুললে একটি ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎবাণী ফলে যাবে। বিশ্বাস করা হয়, এই দরজাটি খুললে তা সারা পৃথিবীর উপর অত্যন্ত ভয়াবহ দুর্যোগ সৃষ্টি করবে। ৪ জুলাই তারিখে সাত সদস্যের কমিটি এখনই দরজাটি না খুলে এর আগে আরও কিছু বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নেন। ধর্মীয় রীতিতে দেবতা যাতে রুষ্ট না হন সেজন্য দরজাটি খোলার আগে ‘অষ্টমঙ্গল দেবপ্রশ্নম’ পালনের সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু সেটি আর খোলা হয়ে উঠে নি। যার করা মামলার কারণে এই মন্দিরের বিষয়টি আদালতে এসেছিল কাকতালীয় ভাবে সেই আইনজীবী পি টি সুন্দররাজন মারা যান সেই মাসে। আর এই ঘটনার কারণে যারা এই দরজা খোলার বিপক্ষে ছিলেন তারা আরও শক্তভাবে বলতে লাগলেন যাতে দরজা খোলা না হয়। এরই মধ্যে ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবারের আপিলের কারণে সুপ্রিম কোর্ট আবার বি ভল্টের দরজা খোলার সিদ্ধান্তকে স্থগিত করে দেয় ২০১২ সালের মধ্যে এ, সি, ডি, ই এবং এফ ভল্টের দ্রব্যসামগ্রীর তালিকাকরণের কাজ শেষ হয়।