Adsense

মহেঞ্জোদারোঃ সিন্ধুর জলে ডুবে যাওয়া এক ইতিহাস

তাম্রযুগের দক্ষিণ এশিয়ার এক রোমাঞ্চকর জায়গার নাম ‘মহেঞ্জোদারো’। সিন্ধু সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন এই মহেঞ্জোদারো। সিন্ধু সভ্যতায় গড়ে ওঠা বৃহত্তম নগর-বসতিগুলির মধ্যে অন্যতম। সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠে এই নগরী। সেসময়ের সুষ্ঠু পরিকল্পনায় গড়ে তোলা নানা স্থাপত্য, পরিপাটি নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে মহেঞ্জোদারো পাল্লা দিতে পারতো আজকের যেকোনো বড় নগরীর সাথে। ১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক বাঙালির হাত ধরে এই শহর পুনরায় আবিষ্কৃত হয়। ৪০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল এই শহরকে আবিষ্কার করতে। সেই আবিষ্কারের পর থেকে মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ প্রবল হয়। নগরীটি বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় অবস্থিত। এটি সাড়ে ৫ হাজার বছরের পুরনো বলে এতোদিন মনে করা হলেও বর্তমানে ‘নেচার’ ম্যাগাজিনের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নগরটি  প্রায় আট হাজার বছরের পুরনো। ইউনেস্কো এ শহরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে ১৯৮০ সালে। মহেঞ্জোদারো একটি সন্ধি শব্দ, যার অর্থ মৃতের পাহাড়। যদিও সেই শহরের আসল নাম কী ছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে মহেঞ্জোদারোর পুরনো শিলা দেখে পুরাতাত্ত্বিকরা একটি দ্রাবিড় নাম খুঁজে পান, সেটি হল কুক্কুতার্মা (Kukkutarma)। মহেঞ্জোদারো গড়ে ওঠার সময়কাল আন্দাজ ২৬০০ খ্রিস্টপূর্ব এবং ধরা হয় আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে এটি জনশুন্য শহরে পরিণত হয়। প্রাচীনকালের এক সমৃদ্ধশালী মহানগর এর প্রতিকৃতি হলো মহেঞ্জোদারো। শহরটি ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির অন্যতম এবং প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া ও ক্রিটের সভ্যতার সমসাময়িক। পানিপথে অন্য নগরীর সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল। তাই এ অঞ্চলে বাইরের মানুষের আগমন খুব কঠিন ছিল। এ অঞ্চলে কৃষিকাজের প্রচলন ছিল বেশি। তবে মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে বাস্তবতা নির্ভর তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। অনেকটা অনুমানের উপর ভিত্তি করে মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নানা কল্পকাহিনী।অনুমান করা হয়, মহেঞ্জোদারো সম্ভবত ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র। সেসময় উন্নতির মধ্যগগনে থাকা মহেঞ্জোদারো ছিল দক্ষিণ এশিয়ার এক সমৃদ্ধশালী নগরী। এই শহরের নগর পরিকল্পনা ও ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবস্থা ছিল অন্যান্য শহরগুলোর থেকে অনেক এগিয়ে। সিন্ধু সভ্যতায় বসবাসরত অধিবাসীদের নিকট এই শহর ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, মহেঞ্জোদারোতে ছিল এতটি মহাশস্যাগার। গ্রামাঞ্চল থেকে গরুর গাড়ি করে আনা শস্য জমা রাখা হত এই শস্যভান্ডারে। শস্য শুকিয়ে রাখারও ব্যবস্থা ছিল এখানে। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদ জোনাথান মার্ক কেনোয়ার এটিকে শস্যাগার বলতে রাজি হননি। তার মতে এখানে শস্য জমা রাখার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি এটিকে “মহাকক্ষ” বা “গ্রেট হল” নামে অভিহিত করেন। কিন্তু ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে একটা শহরের মধ্যে বিশাল শস্যভান্ডার, স্নানাগার সত্যিই কল্পনায় করা যায় না।মহেঞ্জোদারোর অধিবাসীরা কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। বিশেষত, মহেঞ্জোদারোর স্নানাগার এবং শস্যভান্ডারের নিখুঁত নকশা তাক লাগিয়ে দেয়। ঐ সময়ে পুরকৌশল ও নগর পরিকল্পনায় মহেঞ্জোদারো অন্য নগরীগুলোর চেয়ে অনেকাংশে এগিয়ে ছিল বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কারো মতে “মহাস্নানাগার”, আবার কারো মতে “মহাকক্ষ”, খননের সময় খুঁজে পাওয়া মহেঞ্জোদারোর সেই স্থান সিন্ধু নদের তীরে অবস্থিত মহেঞ্জোদারো সবচেয়ে পুরনো পরিকল্পিত শহর। এত যুগ আগের স্থাপত্য হলেও সেখানে দেখতে পাওয়া যায় আধুনিক নির্মাণকার্য। শহরের রাস্তাগুলোও কিন্তু এলোপাথাড়ি তৈরি হয়নি। আধুনিক স্থাপৈত্য শৈলীতে সাজানো পরিকল্পিত শহর প্রত্যেকটি রাস্তারই একটা নির্দিষ্ট ধারা ছিল। এ থেকে অনুমান করা হয় মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দাদের গণিতশাস্ত্রে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল।এখানে প্রাচীন যত বাড়িঘরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তার প্রায় সবই পোড়া মাটির তৈরি দোতলা বাড়ি। কয়েকটি বাড়িতে নিজস্ব স্নানাগারও ছিল এবং বর্জ্য জল যাতে শহরের নর্দমায় গিয়ে পড়ে সেরকম বন্দোবস্তও রাখা ছিল। পরিকল্পিত রাস্তাঘাট পাঁচ হাজার বছর আগে, যখন ইউরোপ এবং অন্য জায়গার মানুষ গুহায়, জঙ্গলে বাস করত, তখন মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা একটি সভ্য ও পরিকল্পিত নগরীতে ইটের তৈরি বাড়িতে বাস করত। নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ছিল বর্তমান সময়ের মতোই আধুনিক। প্রত্যক বাড়িরে বর্জ্য জল যাতে শহরের নর্দমায় গিয়ে পড়ে সেরকম পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার বন্দোবস্তও রাখা ছিল, যা সেসময়ে বেশ অকল্পনীয়। একসময় নগরটিতে যারা বাস করত তাদের পরিকল্পনা দক্ষতার সাক্ষী  বহন করে এসব ড্রেনেজ সিস্টেম। কালের সাক্ষী হিসেবে আজো পুরনো রাস্তাগুলোর সাথে দেখা যায় এসব ড্রেন। পরিকল্পিত নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা মহেঞ্জোদারোর অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই স্নানাগার। নগরীর ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত ‘গ্রেট বাথ’ (মহাস্নান) নামক স্থাপনাটি। বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত সেই স্নানাগারটি। গবেষকদের ধারণা, ধর্মীয় পরিশুদ্ধির জন্য এ জায়গায় গোসল করতে আসতেন পুণ্যার্থীরা। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে একটি পুলের দিকে। পুলের পানি যাতে কোনো কারণে বেরিয়ে না যায়,সেদিকেও নজর ছিল মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দাদের। পানির অপচয় বন্ধ করার জন্য স্নানাগার তৈরি হয়েছিল খনিজ পদার্থের একটা স্তর রেখেই। এক্ষেত্রে শস্যভান্ডারের কথাই ধরা যাক। খাদ্যশস্য মজুত রাখার জন্য সেখানে ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। নকশা বা পরিকল্পনার দৃষ্টিকোণ থেকে এই স্থাপত্যটিও কোনো অংশে কম যায় না। মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দাদের কৃষিকাজ, মৃৎশিল্পে পারদর্শিতা সর্বজনবিদিত শস্যের আদান প্রদানের জন্য উপযোগী বিশেষ রাস্তা ছিল এই স্থাপত্যের পাশে। এমনকি খাদ্যশস্য যাতে অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকে, শস্যভান্ডারে বাতাস চলাচলের জন্যও উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল। সিন্ধুবাসীদের প্রধান কৃষিজ ফসল ছিল গম আর যব। কিন্তু এই শস্যভান্ডারে আদৌ শস্য মজুত থাকতো কি না তা জানা যায় না। সেসময়ের নগরীরর কেনাবেচার হাট মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারাও শিল্প, সংস্কৃতিতে আধুনিক ছিলেন বলে অনেক গবেষকদের অভিমত। শিল্পকলায় মহেঞ্জোদারোবাসীদের আগ্রহ ছিল সে নজির পাওয়া যায়। পোড়ামাটির তৈরি নানা শৈল্পিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দাদের তৈরি পোড়ামাটির নানা শৈল্পিক নিদর্শন অধিবাসীদের মধ্যে অলঙ্কার ব্যবহারের প্রচলন ছিল। গলার হার, কানের দুল, আংটি, হাতের ব্রেসলেট জাতীয় গয়না পরার চল ছিল নারীদের মধ্যে।মহেঞ্জোদারোর মহিলাদের ব্যবহৃত অলঙ্কার শুধু তাই নয়, মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা নাচ-গান ও খেলাধুলায় বেশ পারদর্শী ছিল। যদিও সেখানকার বাসিন্দারা  তাদের শহরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে বেশ যত্নশীল ছিলেন। শহরের সাফ-সাফাইয়ের উপর বিশেষ নজর দিতেন। বিশেষজ্ঞের মতে, মহেঞ্জোদারো বেশ সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। মহেঞ্জোদারোয় হাতির দাঁত, বিভিন্ন ধরনের পাথর থেকেই এই মতেই পৌঁছানো যায়। মহেঞ্জোদারো ছিল তৎকালীন সময়ের নাগরিক সভ্যতা। নগরীর শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন একটা জানা যায় না। তবে সমকালীন মিসরীয় সভ্যতার শাসন-কাঠামো লক্ষ্য করে অনুমান করা হয়, একধরনের পুরোহিততান্ত্রিক শাসন এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ নিয়ে শক্তিশালী কোনো তথ্য প্রমাণ মিলে নি।নিখুঁত নগর নির্মাণের মতোই চমকে দেয় মহেঞ্জোদারোর পতন। অনেকে বলেন, সিন্ধু নদীর আকস্মিক গতি পবির্তনের কারণেই হয়তো মহেঞ্জোদারো এবং সামগ্রিকভাবে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘনিয়ে এসেছিল। তবে কোনো বড় ধরনের বন্যার জন্য সভ্যতার ধ্বংস হওয়ার যুক্তিও ধোপে টেকে না। শহরের ভগ্নাবশেষ পরীক্ষা করে বন্যার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রত্নতাত্মিকদের অনুমান, সিন্দু নদের গতি পরিবর্তনেই মহেঞ্জোদারো ধাবংসের কারণ কিন্তু কেন মহেঞ্জোদারো জনমানবহীন হয়ে পড়লো সেই রহস্যটার সমাধান এখনো করা যায়নি। শোনা যায়, মহেঞ্জোদারো নাকি প্রায় সাতবার ধ্বংস করে সাতবারই নাকি নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল, সেই পুরনো শহরের উপরেই। প্রায় ২৫০ একর জমির উপর ঢিপির নীচে লুকিয়ে ছিল মহেঞ্জোদারো। মহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন স্তুপ থেকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে সেসময়ের বিভিন্ন মূর্তি, যেগুলোর অধিকাংশই ভাঙা। এই মূর্তিগুলো ঐতিহাসিক গবেষণার কাজে বা সিন্ধু সভ্যতাকে আরো বিস্তারিতভাবে জানার কাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হারিয়ে যাওয়া এই সভ্যতা এখনো অনেকের কাজে রহস্যের আধার।
সৌজন্যে রোয়ার মিডিয়া।

No comments: