Adsense

উপমহাদেশের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ

সৌজন্যেঃ ফ্রন্টলাইন বাংলাদেশ।
 উপমহাদেশের সব থেকে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কলিংগ
প্রতিটি রাজ্য দখল, রাজত্বকে টিকে রাখা, রাজ্য জয় আর ক্ষমতা, প্রতিপত্তির অর্জনের জন্য সংগঠিত হয় যুদ্ধ। আর এসব যুদ্ধে রয়েছে যেমন অগণিত সাধারণ মানুষের ত্যাগ আর তেমনি রয়েছে অসংখ্য মানুষের রক্তাক্ত বিসর্জনের ইতিহাস। তবুও দিন শেষে সাম্রাজ্যের আভিজাত্য আর রাজার বীরত্ব যুদ্ধ জয়ের প্রতীক হয়ে উঠে। হারিয়ে যায় সেই সব মানুষের জীবন দেওয়া, প্রতিটি মুহূর্ত ত্যাগ শিকার করা সাধারণ মানুষগুলোর গল্প। এটাই যে জগতের নিয়ম। ইতিহাসের বেশিরভাগ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে হয় নিজের দেশকে বাঁচাতেই; নাহয় অন্যের রাজ্য জয় করতে। তেমনি একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ ছিল কলিঙ্গের যুদ্ধ। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট দ্যা গ্রেট, রাজা অশোক কে ঘিরেই রচিত হয় এ যুদ্ধকাহিনী।
কে এই রাজা অশোক? ভারতীয় উপমহাদেশে যে দুজন রাজাকে গ্রেট উপাধি দেয়া হয়েছে তাদের একজন হলেন অশোক দ্য গ্রেট, অপরজন হল আকবর দ্য গ্রেট। মজার ব্যাপার হল, হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে একজন হিন্দু রাজাও এই উপাধি লাভ করেননি। অশোক প্রথম জীবনে বৈদিক ধর্মের অনুসারী হলেও পরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন আর আকবর ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের যদিও অনেক ঐতিহাসিক তাকে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী বলেন, কারণ তিনি পরে নিজেই ‘দ্বীন এ এলাহী‘ ধর্ম প্রবর্তন করেন যাতে সব ধর্মের সংমিশ্রণ ঘটান যা ইসলামে সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ।ভারতের মৌর্য রাজবংশের তৃতীয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক। তার পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতের বুকে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৪ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন। সম্রাটবিন্দুসার-এর ঔরসে রানি ধর্মা (মতান্তরে সুভদ্রাঙ্গির) গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। উত্তর-ভারতের কিম্বদন্তী অনুসারে চম্পাদেশীয় রাজকন্যা ‘সুভদ্রাঙ্গী’ ছিলেন অশোকের মা। আর দক্ষিণ ভারতীয় কিম্বদন্তী অনুসারে তাঁর মায়ের নাম ছিল ধর্মা। তাঁর চারজন স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- তিশ্যারাক্ষ, পদ্মবতী, কারুভাকী, বিদিশা।

মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে রাজা বিন্দুসার অশোক কে উজ্জ্বয়িনীর শাসনকর্তা নিয়োগ করেন।তক্ষশীলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, তক্ষশীলায় বিদ্রোহ শুরু হলে বিন্দুসার তাঁকে বিদ্রোহ দমনের জন্য তাঁকেতক্ষশীলায় পাঠান। অশোক এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হলে, তাঁকে তক্ষশীলার শাসনভার লাভ করেন। এই সময় তিনি মহাদেবীকে বিবাহ করেন।
বিন্দুসার-এর অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের দখল নিয়ে রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বৌদ্ধ কিম্বদন্তী অনুসারে জানা যায়, বিন্দুসারের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ১৬টি এবং পুত্রের সংখ্যা ছিল ১০১টি। তাঁর মৃত্যুর তাঁর পুত্র অশোক অন্যান্য ভাইদের পরাজিত ও হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছিলেন। সিংহলীয় উপাখ্যানসমূহে পাওয়া যায়, তিনি তাঁর ৯৮জন ভাইকে হত্যা করেছিলেন। এই জন্য তাঁকে চণ্ডশোক বলা হয়েছে। সিংহাসন দখলের পর, ‘দেবানাম-প্রিয়-পিয়দাসী’ অর্থাৎ ‘দেবতাদের প্রিয় প্রিয়দর্শী’ উপাধি ধারণ করেন। ধারণা করা হয় তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দের দিকে সিংহাসন লাভ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সম্রাট হিসেবে অভিষেক হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ অব্দের দিকে। অশোকের সাম্রাজ্য পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে পূর্বে বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সিংহাসনের বসার পর তিনি তার পিতামহের রাজ্য বিস্তৃতিতে মনোযোগ দেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০-৬৩ অব্দের দিকে তিনি কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেন। এর আগেও মৌর্য বংশের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত একবার কলিঙ্গ জয় করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। তার পুত্র সম্রাট বিন্দুসারও একবার কলিঙ্গ অভিযান চালান এবং ব্যর্থ হন। কিন্তু কিন্তু সম্রাট অশোক দমে যাওয়ার পাত্র নন। ভারতের বুকে কলিঙ্গ রাজ্য দক্ষিণাঞ্চলের সাথে উত্তর প্রদেশের যোগসূত্র হিসেবে অবস্থান করছিল। কলিঙ্গ জয় করতে পারলে দক্ষিণের অভিযান পরিচালনা করা অনেক সহজ হয়ে যাবে। এই কথা মাথায় রেখে সম্রাট অশোক নতুন করে কলিঙ্গ জয়ের নকশা শুরু করেন। এই যুদ্ধে কলিঙ্গবাসী সর্বশক্তি দিয়ে অশোককের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরও কলিঙ্গবাসী পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে এক লক্ষ নরনারী প্রাণ হারায় এবং প্রায় দেড়লক্ষ নরনারী বন্দী হয়। এই যুদ্ধের এই বীভৎসতা সম্রাট অশোককে বিষাদগ্রস্থ করে তোলে। পরে তিনি যুদ্ধের পথত্যাগ অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনের নীতি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ক্রমে ক্রমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং উপগুপ্ত নামক এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর থেকে তিনি অহিংসা নীতি গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর গুরু উপগুপ্তকে সাথে নিয়ে কপিলাবস্তু, লুম্বিনী, কুশীনগর, বুদ্ধগয়া-সহ নানা স্থানে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করেন। এই সময় তিনি নানা স্থানে স্তূপ, স্তম্ভ এবং পাহাড়ের গায়ে বুদ্ধের বাণী লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করেন। জনকল্যাণের জন্য তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। জলকষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে জলাশয় তৈরি করে দেন। অশোকের এই অহিংস নীতির কারণে, তাঁর সাথে প্রতিবেশী রাজ্য এবং গ্রিকদের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠে। তিনি সিরিয়া, মিশর, এপিরাস, সিংহল, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, নেপাল প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য প্রতিনিধি পাঠান। 
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্তের আমলে মৌর্যদের অধীনে ৬ লাখ পদাতিক, ৩০ হাজার অশ্বারোহী, ৯ হাজার হাতি এবং ৮ হাজার যুদ্ধরথ বিদ্যমান ছিল। সম্রাট অশোকের আমলে তা সেনাবাহিনীর সংখ্যা কয়েকগুন বৃদ্ধি পায়। এমনকি তিনি সিরিয়া থেকে সুদক্ষ সেনাসদস্য এনে তার দলে ভেড়ান। এ থেকেই বোঝা যায় সম্রাট অশোক কলিঙ্গ জয়ের জন্য কেমন মরিয়া ছিলেন!
খ্রিষ্টপূর্ব  ২৩২ অব্দে সম্রাট অশোক মৃত্যুবরণ করেন। তিব্বতীয় কিম্বদন্তী অনুসারে জানা যায় তিনি তক্ষশীলায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন।  প্রাচীন ভারতের শক্তিশালী রাজ্যগুলোর একটি হল কলিঙ্গ। এটি ভারতের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাংশ এবং মধ্য প্রদেশের কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত ছিলো বলে ধারণা করা হয়। এই রাজ্যটি গঙ্গা নদী থেকে শুরু করে গোদাবরী নদী পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর থেকে অমরকণ্টক পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। বর্তমানে মানচিত্রে দেখলে প্রাচীন কলিঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ নগরীসমূহকে নব্য উড়িষ্যার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়। 
তৎকালীন কলিঙ্গ রাজ্যটি অর্থনৈতিকভাবে ছিলো সমৃদ্ধ এবং এর ভূমি ছিলো উর্বর। প্রচুর ফসল-ফলাদি উৎপাদন হত। এই রাজ্যের অধীনে বেশ কিছু সমুদ্র বন্দর ছিল। যার বদৌলতে কলিঙ্গ ব্যবসা-বাণিজ্যে ভারতবর্ষের শীর্ষে আরোহণ করে। কলিঙ্গ রাজ্যের সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল ‘হাতি’। প্রাচীন ভারতে কলিঙ্গের হাতির মতো বিশাল হাতি আর কোথাও কেউ দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে। তৎকালীন গ্রিক পণ্ডিত দিউদারাসের পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে পাওয়া যায়, কোনো বহিরাগত রাষ্ট্রের আক্রমণের মুখে কলিঙ্গ মুখ থুবড়ে পড়েনি। কলিঙ্গের শক্তিশালী হস্তিবাহিনীর সাথে পাল্লা দেয়ার মতো ক্ষমতাধর রাজ্য তখন একটিও ছিল না”। কলিঙ্গ রাজ্যের সামরিক শক্তি ছিল অদম্য। হস্তিবাহিনী ছাড়াও কলিঙ্গের সাধারণ সৈন্য সংখ্যা যেকোনো রাজ্য থেকে বেশি ছিল। গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস তার পাণ্ডুলিপিতে পরোক্ষভাবে কলিঙ্গের সামরিক শক্তির বর্ণনা তুলে ধরেন। তিনি লিখেন, “প্রথম মৌর্য সম্রাটের সময় কলিঙ্গের রাজার রক্ষার্থে প্রায় ৬০ হাজার পদাতিক, ১ হাজার অশ্বারোহী এবং ৭০০ হাতি মজুদ ছিল।” যদি রাজার ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষায় এত বড় বাহিনী নিয়োজিত থাকে, তাহলে পুরো রাজ্য জুড়ে কত বিশাল বাহিনী নিয়োজিত থাকতে পারে। 
যুদ্ধের কারণ
প্রতিবেশী দুটি সাম্রাজ্য মগধ এবং কলিঙ্গ। মগধ অপেক্ষাকৃত বড়, তার শক্তিও তুলনায় বেশি। তবুও মগধ সম্রাটের মনে শান্তি নেই। প্রতিবেশী এক শত্রুকে রেখে কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়!!! কলিঙ্গ যুদ্ধের সঠিক কারণ নিয়ে ইতিহাসে শক্ত কোনো দলিল মেলেনি। তবে কলিঙ্গ জয়ের মাধ্যমে মৌর্যরা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকে লাভবান হবেন- কথাটি সম্রাট অশোক জানতেন। ইতিহাসবিদদের মতে, কোনো রাজ্য যদি মৌর্যদের বিরুদ্ধে সমান তালে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে, তাহলে সেটা কলিঙ্গ রাজ্য। অর্থাৎ মৌর্যদের ভারত শাসনে কলিঙ্গ ছিল পথের কাঁটা। তাছাড়া দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীই শক্তিশালী। কিন্তু মগধের সৈন্যরা অনেক বেশি যুদ্ধপটু আর কৌশলী। কলিঙ্গের সৈন্যরা বীর বীক্রমে লড়াই করেও পরাজিত হয়। আহত আর নিহত সৈন্যে ভরে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র। রক্তাক্ত হলো সমস্ত প্রান্তর। কলিঙ্গরাজ নিহত হলেন। 
কলিঙ্গ যুদ্ধের দামামা…..
কলিঙ্গ যুদ্ধের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ সালে। সম্রাট অশোক তার শাসনের দ্বাদশ (মতান্তরে অষ্টম) বছর পূর্তিতে কলিঙ্গ অভিযানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন কলিঙ্গ রাজ্য তৎকালীন জাভা, সিংহল এবং মালয় রাজ্যের সাথে হাত মিলিয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। 
সম্রাট অশোক আর দেরি করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি কলিঙ্গের রাজা আনন্দ পদ্মানাভানের নিকট দূত প্রেরণ করলেন। অশোক অবিলম্বে কলিঙ্গকে মৌর্য বংশের সমীপে আনুগত্য স্বীকার করার আদেশ  দেন। রাজা আনন্দ এই অপমানে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে অশোকের দাবি নাকচ করে দেন। সম্রাট অশোক যেন এই বার্তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি নিজে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী নিয়ে কলিঙ্গের দিকে যাত্রা শুরু করেন। ওদিকে কলিঙ্গের যোদ্ধারাও নিজেদের অস্ত্র শাণ দিতে থাকেন। সম্রাট অশোকের শাসনামলে কলিঙ্গ যুদ্ধই একমাত্র যুদ্ধ যেখানে তিনি সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। 
অশোকের সুসজ্জিত বিশাল বাহিনীর সাথে কলিঙ্গ বাহিনীর প্রথম সাক্ষাত হয় ধৌলি পাহাড় ময়দানে। সেখানে দুই বাহিনী তাদের সকল শক্তি নিয়ে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমদিক থেকেই অশোকের কলাকৌশলের কাছে কলিঙ্গের সৈনিকরা পেরে উঠছিলেন না। কিন্তু কলিঙ্গের শক্তিশালী বাহিনী এত সহজে পরাজয় স্বীকার করতে নারাজ। তারা বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করে ঘুরে দাঁড়াতে থাকেন। যুদ্ধে দু’পক্ষেরই ব্যাপক রক্তক্ষয় হয়। সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তাই তিনি ভালো করেই জানতেন কীভাবে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফের কলিঙ্গ সৈন্যরা পিছু হটতে থাকেন। সম্রাট অশোক ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি জয়ী হয়েছেন, কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। কলিঙ্গ সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে যোগ দেয় সাধারণ জনগণ। তৎকালীন জনগণের মাঝে স্বাধীনতাবোধের এই দৃষ্টান্ত ছিলো বিরল। সময় যত গড়াতে থাকে, যুদ্ধের তীব্রতা তত বাড়তে থাকে। যুদ্ধের শুরু ধৌলি পাহাড় ময়দানে হলেও দেখতে দেখতে একসময় সেটা পুরো কলিঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কলিঙ্গের সক্ষম পুরুষরা যুদ্ধে যোগদান করতে থাকেন।যুদ্ধের ময়দান ক্রমেই লাশের পর লাশের স্তূপ গড়ে ওঠে। কলিঙ্গের আকাশে তখন শকুনের আনাগোনা। এই বীভৎস দৃশ্য দেখে যে কারো মন বিষিয়ে উঠবে। কিন্তু কোনো পক্ষই হাল ছেড়ে দিতে রাজি নয়। যুদ্ধ চলতে থাকে পুরোদমে। যুদ্ধক্ষেত্রের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শান্ত নদী দায়া। দেখতে দেখতে দায়া নদীর পানি রক্তের মিশেলে টকটকে লাল হয়ে গেল। নদীর স্রোত সেই রক্ত নিয়ে পুরো ভারত জুড়ে বয়ে চললো, ছড়িয়ে দিলো কলিঙ্গের হাহাকার! একসময় মনে হচ্ছিল যুদ্ধের ফলাফল কলিঙ্গদের পক্ষে যাবে, কিন্তু অপরাজেয় অশোক শেষপর্যন্ত বিজয়ী হলেন। কলিঙ্গের প্রতিটি সৈনিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেলেন। প্রায় এক বছরব্যাপী চলা যুদ্ধে আনুমানিক ১ লক্ষ ৫০ হাজার কলিঙ্গ সেনা প্রাণ হারান। অপরদিকে প্রায় ১ লক্ষ মৌর্য সৈনিক প্রাণ হারান। কথিত আছে, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কলিঙ্গে শ্রম খাটানোর জন্য কোনো জীবিত দাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। 
পরাজিত কলিঙ্গ…কিন্তু শেষ হল না যুদ্ধ…………কলিঙ্গ যুদ্ধের বিজয়ী সম্রাট অশোক যুদ্ধ শেষে যখন কলিঙ্গের ময়দানে বীরদর্পে পদচারণা করেন, তখন চারিদিকে মানুষের আহাজারি, কান্না আর আর্তনাদ তার মনকে ব্যথিত করে তুলে। কলিঙ্গের ঘরে ঘরে বিধবা আর পিতৃহীনদের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠলো। সম্রাট অশোক এই বিজয় চাননি। তিনি কলিঙ্গ চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিণামে পেলেন এক মৃত্যুপুরী, যার কারিগর তিনি নিজে। বিজয়ী সম্রাট অশোক হাতির পিঠে চেপে যেতে যেতে দেখলেন তার দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কত অসংখ্য মৃতদেহ। কত আহত সৈনিক। কেউ আর্তনাদ করছে, কেউ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চিৎকার করছে। কেউ সামান্য একটু পানির জন্য ছটফট করছে। আকাশে মাংসের লোভে শকুনের দল ভিড় করছে। লোকমুখে প্রচলিত আছে,  যুদ্ধক্ষেত্রের এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে সম্রাট বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। অনুভব করলেন তার সমস্ত অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে নিজের তাঁবুতে ফিরে দেখলেন শিবিরের সামনে দিয়ে চলেছে এক তরুণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসী বললেন, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের সেবা করতে চলেছি। আরও শোনা যায়, যুদ্ধের পর এক কলিঙ্গ বৃদ্ধা অশোকের দরবারে হাজির হন। কলিঙ্গে যুদ্ধে বৃদ্ধার স্বামী, পিতা এবং সন্তান প্রাণ হারান। তিনি কাঁদতে কাঁদতে সম্রাটকে প্রশ্ন করেন, “আপনার কারণে আমি সব হারিয়েছি। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচবো?”  এই প্রশ্ন সম্রাটকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলে। ময়দানের যুদ্ধ ঠিকই শেষ হয়ে গেল, কিন্তু অশোকের মনে তখনো যুদ্ধ চলছিল। তার পক্ষে এই গ্লানি সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়েন শক্তিধর সম্রাট। মুহূর্তে অনুতাপের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সম্রাটের হৃদয়। সম্রাটের অন্তরে জ্বলে উঠল নতুন এক প্রজ্ঞার আলোক। তিনি শপথ করলেন আর যুদ্ধ নয়, আর হিংসা নয়, ভগবান বুদ্ধের করুণায় আলোয় অহিংসা মন্ত্রে ভরিয়ে দিতে হবে সমগ্র পৃথিবী। এরপর তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যবাদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। তিনি নিজে আর যুদ্ধে অংশ নেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং অহিংস নীতির অনুসারী হন। এভাবে কলিঙ্গ যুদ্ধের ফলে অশোকের রাজ্য পরিচালনা নীতিতে অনেক বড় পরিবর্তন আসে। তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সম্রাট অশোকের গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো- অশোক ঘোষণা করলেন আর যুদ্ধ নয়, এবার হবে ধর্ম বিজয়। ভ্রাতৃত্ব প্রেম, করুণার মধ্যে দিয়ে অপরকে জয় করতে হবে। শুধুমাত্র নির্দেশ প্রদান করেই নিজের কর্তব্য শেষ করলেন না। এত দিন যে রাজসুখ বিলাস ব্যসনের সাথে পরিচিত ছিলেন তা পরিত্যাগ করে সরল পবিত্র জীবনযাত্রা অবলম্বন করেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের যুদ্ধ নীতি রদ করেন। যুদ্ধের মাধ্যমে সাম্রাজ্য বিস্তারের পন্থা বাতিল করেন। এমনকি অস্ত্র স্পর্শ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।তিনি সকল প্রতিবেশী দেশের রাজাদের কাছে দূত পাঠিয়ে ঘোষণা করেছিলেন তিনি তাদের সাথে মৈত্রী, প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান। সকলে যেন নির্ভয়ে আপন রাজ্য শাসন করেন। এমনকি সম্রাট অশোক তার উত্তরাধিকারীদের কাছেও দেশ জয়ের জন্য যুদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি তাদের উপদেশ দিতেন অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, প্রেম করুণা সহৃদয়তার মধ্যে দিয়েই মানুষকে জয় কর। এই জয়কে সম্রাট অশোক বলতেন ধর্ম বিজয়। যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন। প্রধানত তারই প্রচেষ্টায় পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে। তবে তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য শুধু যে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারকদের পাঠাতেন তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্তম্ভ পর্বত শিলাখণ্ডের ওপর বিভিন্ন উপদেশ উৎকীর্ণ করে দিতেন যাতে সেই অনুশাসন পাঠ করে প্রজারা তা পালন করতে পারে। অশোক এসব অনুশাসনে যে সমস্ত উপদেশ দিয়েছেন তার সাথে বৌদ্ধদের অষ্টমার্গের বিশেষ মিল নেই। অশোকের নির্দেশে বহু পথ নির্মাণ করা হলো। এই সমস্ত পথের দুপাশে প্রধানত বট এবং আম গাছ পোঁতা হতো। যাতে মানুষ ছায়ায় পথ চলতে পারে। ক্ষুধার সময় গাছের ফল খেতে পারে। প্রতি আট ক্রোশ অন্তর পথের ধারে কূপ খনন করা হয়েছিল। শুধু মানুষ নয়, পশুদের প্রতিও ছিল তার গভীর মমতা। তিনি সমস্ত রাজ্যে পশুহত্যা শিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে তিনিই প্রথম পশুদের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। সর্বজীবের প্রতি করুণায় এমন দৃষ্টান্ত জগতে বিরল। অশোক বৌদ্ধ হলেও অন্য কোনো ধর্মের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ ছিল না। সকলেই যে যার ধর্ম পালন করত। একটি শিলালিপিতে তিনি লিখেছেন, নিজের ধর্মের প্রতি প্রশংসা অন্যের ধর্মের নিন্দা করা উচিত নয়। পরস্পরের ধর্মমত শুনে তার সারবস্তু, মূল সত্যকে গ্রহণ করা উচিত। ধর্মচরণে অধিক মনোযোগী হলেও রাজ্যশাসনের ব্যাপারে সামান্যতম দুর্বলতা দেখাননি। পিতা-পিতামহের মতো তিনিও ছিলেন সুদক্ষ প্রশাসক। সুবিশাল ছিল তার রাজ্যসীমা। তিনি শাসনকাজের ভার উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতেই দিতেন এবং প্রয়োজনমতো তাদের নির্দেশ দিতেন। তিনি ভারত জুড়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর ছিলেন।সম্রাট অশোক তার সমস্ত জীবন প্রজাদের সুখ কল্যাণে তাদের আত্মিক উন্নতির জন্য ব্যয় করেছিলেন। তবুও তার অন্তরে দ্বিধা ছিল। একজন সম্রাট হিসেবে তিনি কি তার যথার্থ কর্তব্য পালন করছেন? একদিন গুরুকে প্রশ্ন করলেন, গুরুদেব, সর্বশ্রেষ্ঠ দান কী? বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ দান ধর্মদান। একমাত্র ধর্মের পবিত্র আলোতেই মানুষের অন্তর আলোকিত হয়ে উঠতে পারে। তুমি সেই ধর্মদান কর। গুরুর আদেশ নতমস্তকে গ্রহণ করলেন অশোক। তারই অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের সুমহান বাণী।  সুদূর সিংহলে নয় তিনি ভারতের বাইরে বিভিন্ন সাম্রাজ্যে অহিংসার বাণী প্রচার করেন। শ্রীলংকা, গ্রীস, মেসিডোনিয়া এবং সিরিয়াতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।তিনি হাজার হাজার স্তম্ভ নির্মাণ করেন। সেখানে অহিংসার বাণী খোদাই করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বর্তমান ভারতের জাতীয় প্রতীক বিখ্যাত ‘অশোক স্তম্ভ’ এখনো সেই ঘটনার স্মৃতি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। অশোকের ধর্ম নীতি ও প্রচার অশোক বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের অনুরাগী ছিলেন। তবে তাঁর ধর্ম প্রচারণা এবং জীবনাদর্শ বৌদ্ধ ধর্ম প্রাধান্য পেয়েছিল। অশোক বিহারযাত্রার পরিবর্তে ধর্মযাত্রার প্রচলন করেছিলেন। তীর্থযাত্রার সাথে তিনি যুক্ত করেছিলেন শ্রমণদের উপহার দান, বুদ্ধের বাণী প্রচার এবং নানাবিধ উপদেশের মধ্য দিয়ে মানুষকে ধর্মভাবাপন্ন করার কার্যক্রম। সাধারণ মানুষকে বৌদ্ধ ধর্মে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে  (পাহাড়ের গায়ে, পাথরের স্তম্ভে, পর্বতগুহায়) বুদ্ধের বাণী এবং উপদেশ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ধর্মীয় প্রচারের জন্য তিনি রাজুক, যুত এবং মহাপাত্র নামক পদের সৃষ্টি করেছিলেন। এঁরা অশোকের ধর্মনীতিকে প্রচার করতেন। এছাড়া রাজকর্মচারীদের দ্বারা সাধারণ মানুষ যাতে নিগৃহীত না হয়, তার জন্য ধর্মমহাপাত্র নামক কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সংহতি স্থাপনের জন্য এবং বৌদ্ধ সংঘসমূহের ভিতরে আন্তসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাটালিপুত্র নগরে একটি বৌদ্ধ-সংগীতি আহ্বান করেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের জন্য তিনি রাজপুত্র মহেন্দ্রকে সিংহল দ্বীপে পাঠিয়েছিলেন। অশোক লিপি অশোক নানারকমের বাণী পাহাড়ের গায়ে, পাথরের স্তম্ভে, পর্বতগুহায় লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করেন। যে সকল লিপিতে এই বাণী লেখা হয়েছিল, সে সকল লিপিকে সাধারণভাবে অশোকলিপি বলা হয়। এই সকল বাণী লেখা হয়েছিল ব্রাহ্মীলিপি ও খরোষ্ঠীলিপিতে। অবশ্য ব্রাহ্মীলিপির আদিপাঠগুলো সম্রাট অশোকের নির্দেশে স্থাপিত হয়েছিল বলে, অনেকে এই লিপিকে অশোকলিপি নামে অভিহিত করেছেন। আবার অশোক ছিলেন মৌর্যবংশীয় রাজা। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৭ বা ১৮৫ অব্দে, মৌর্যবংশীয় শেষ রাজা বৃহদ্রথকে তাঁর সেনাপতি পুষ্যামিত্র শুঙ্গ হত্যা করে মৌর্য সিংহাসন দখল করেন।  মৌর্যবংশীয় রাজাদের সময়ে প্রচলিত ব্রাহ্মীলিপিকে মৌর্যলিপি বলা হয়। ভাষা বিজ্ঞানীরা খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীকে মৌর্যলিপির সময় সীমা ধরে থাকেন।অশোকস্তম্ভ ও অশোক চক্র অশোক স্তম্ভ হল চারটি সিংহের মুখযুক্ত একটি একক মূর্তি। এই সিংহ চারটির পশ্চাৎ অংশ যুক্ত থাকে এবং মুখগুলো চারটি দিকে নির্দেশ করে। এর ফলে যে কোন দিক থেকে তিনটি সিংহের মুখ একবারে দেখা যায়। এই চারটি সংযুক্ত সিংহমূর্তি একটি একটি উল্টানো পদ্মফুলের উপরে বেদীটি স্থাপিত থাকে। এই বেদীর পার্শ্ব বরাবর খোদিত আছে চারটি প্রাণীর রিলিফ মূর্তি। এই প্রাণীগুলো হলো― একটা হাতি, একটি দৌড়ানো ঘোড়া, একটা ষাঁড় এবং একটি সিংহ। এই চারটা জন্তুর মাঝে রয়েছে একটি করে চক্র। এই চক্রকে বলা হয় অশোক চক্র বা ধর্ম চক্র। অশোক চক্রের কেন্দ্র থেকে ২৪টি শলাকা, সাইকেলের চাকার মতো এর ছড়ানো। তবে এই শলাকাগুলো এর পরিধির সাথে যুক্ত থাকে না। এর শলাকাগুলো ২৪টি বিষয়ের প্রতীক হিসেবে নির্দেশিত হয়। বৌদ্ধধর্মগ্রন্থ সুত্তা নিপোতায় বলা হয়েছে―শাক্যদের একটি গ্রাম লুম্বিনিয়া জনপদে গৌতম বুদ্ধ জন্ম হয়। বৌদ্ধ পুরাণ অনুযায়ী গৌতম বুদ্ধের মা মায়াদেবী শাক্য রাজধানী কপিলাবস্তু থেকে তার পৈতৃক বাসগৃহে যাচ্ছিলেন । পথিমধ্যে লুম্বিনি বনে একটি শালগাছের নিচে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। বুদ্ধের জন্মের আগে মায়াদেবী এখানে একটি দীঘিতে স্নান করেন।সিদ্ধার্থ গৌতমকেও জন্মের পর এই দীঘিতে স্নান করানো হয়। পরে এখানে মায়াদেবী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মন্দিরের একটি স্থানকে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে অশোক এই তীর্থভূমি পরিদর্শনে এসেছিলেন। অশোকের আগমনের স্মারক হিসেবে এখানে একটি অশোক স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে অশোক স্তম্ভকে কেন্দ্র করেই এই ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক স্থানটি পুনরাবিষ্কার করা হয়। ষষ্ঠ শতকে বিখ্যাত চীনা সন্ন্যাসী ও পর্যটক ফা হিয়েন ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শনের সময় কপিলাবস্তু ও লুম্বিনিতে আসেন। তিনি তাঁর সুবিখ্যাত ভ্রমণকাহিনীতে সম্রাট অশোকের স্মারক স্তম্ভের বর্ণনা দেন এবং গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে লুম্বিনির উল্লেখ করেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে নেপালের তৎকালীন শাসক খাদগা সোমেশ্বর রানার উদ্যোগে নেপালী প্রত্নতত্ববিদরা ফা হিয়েনের ভ্রমণকাহিনী,বৌদ্ধপুরাণ ও ইতিহাসগ্রন্থ সুত্ত নিপোতা,বৌদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ মহাবংশসহ অন্যান্য গ্রন্থ এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের সাহায্যে অশোক স্তম্ভটি খুঁজে বের করেন। আর এর মাধ্যমেই গৌতম বুদ্ধের জন্ম স্থানটি নির্দেশ করা সম্ভব হয়। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক অশোক স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমানে অশোকস্তম্ভকে ভারত প্রজতন্ত্রের জাতীয় প্রতীক করা হয়েছে। উল্লেখ্য অশোক তাঁর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী স্ত্রী বিদিশার পরামর্শে সারনাথে গৌতম বুদ্ধের দীক্ষাস্থলকে স্মরণী করে রাখার জন্য একটি স্তম্ভ স্থাপন করেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে পুরাতত্ত্ব বিভাগের খনন কার্যের সময় এই অশোকস্তম্ভটি উদ্ধার করা হয়। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার এই স্তম্ভের চিত্রকেকে রাজকীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছে। মূল সারনাথ যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এর উচ্চতা ২ মিটার। সম্রাট অশোককে ভারতের ইতিহাসে ‘মহান’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তার মাহাত্ম্যের পিছনে কলিঙ্গ যুদ্ধের ভূমিকা অপরিসীম। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের বুকে শান্তির বাণী প্রচারিত হয় যা যুগ যুগ ধরে এখনো টিকে আছে। পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই কলিঙ্গ যুদ্ধ। ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতের ইতিহাসে এর চেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর কখনো হয়নি। কলিঙ্গ যুদ্ধ শুধু ইতিহাসের রোমাঞ্চকর ঘটনা নয়, এর মাঝে লুকিয়ে আছে অন্তর্নিহিত বাণী। বর্তমানে পৃথিবীর বুকে শান্তি বজায় রাখতে হলে আমাদের এই বাণী বুকে ধারণ করতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে হয়তো নতুন কোনো কলিঙ্গ যুদ্ধের সাক্ষী হতে হবে আমাদের।

No comments: