google-site-verification: google90012c42a1ba93ca.html

google-site-verification: google90012c42a1ba93ca.html

শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজির সূচনা

ফেরিওয়ালা নিবেদিত  
বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি ও শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়ে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন।   ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলায় শাসন  শোষণ পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের জয়ের মধ্য দিয়ে  এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে  ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়। ১৭৯৩ সালে-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ দেয় ব্রিটিশ সরকার। এর মেয়াদ ছিল পরবর্তী বিশ বছরের জন্য। এই উপমহাদেশে শাসন করতে এসে কোম্পানিকে প্রতিনিয়ত কোন না কোন ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে হতো। বহু সংস্কৃতির ভারতে এসে প্রথমেই তাদের যে সমস্যায়  পড়তে হয় তা হলো  ভাষাজনিত সমস্যা। মুঘল শাসকদের অনেক বছর রাজত্বের ফলে  এখানে আরবি ও ফার্সি ভাষা প্রচলিত হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। এমনকি আদালত আর অনেক অফিসের প্রধান ভাষা ছিল ফার্সি। আর হিন্দু আধিক্যের এই এলাকায় সংস্কৃত ভাষা চর্চাও প্রচলিত ছিল। আবার প্রত্যেক  অঞ্চলের মানুষের ছিল  নিজস্ব মাতৃভাষা। ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের জন্য আগমনের শুরু থেকেই ইংরেজরা ভাষার সমস্যা উপলব্ধি করতে লাগল। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছেও ইংরেজি ভাষা প্রায়ই নতুন। আবার কোম্পানির সাথে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে  ইংরেজি ভাষাটাও একটা আবশ্যকীয় ব্যাপার হয়ে দাড়াল। স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির ব্যবসায়ীরা এমন কাউকেই তাদের অধীনে কর্মচারী হিসেবে চাইতোনা যারা তাদের সাথে ভাবের আদান প্রদানে সহজে করতে পারবেনা। রাজত্ব যখন কোম্পানির আর তারা ইংরেজ অতএব   ইংরেজি মুখ্য ভাষা হয়ে দাড়াল সমাজের ধনিক শ্রেণীর  কাছে। আবার  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও প্রশাসনিক কার্য ভালভাবে চালানোর জন্য স্থানীয় লোকেদের মুখের ভাষায় দক্ষ হওয়াটাকে গুরুত্বের সাথে নিতে লাগলেন। প্রথমদিকে ব্যবসায়িক কাজের পাশাপাশি এ অঞ্চলের প্রশাসনিক দেখভাল করাটাও কোম্পানির হাতেই ন্যস্ত ছিল বলে  প্রথমদিকে এ অঞ্চলের শিক্ষার প্রসারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অনেকটাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে দায়ভার নিতে হয় যদিও তখনো এটাকে তাদের উপর বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
ভারতবর্ষে শিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারীদের অবদানও উল্লেখযোগ্য। যদি তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবতে হয়  তাহলে কলকাতা মাদ্রাসা আর সংস্কৃত কলেজের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তা সহজে বোঝা যায়। ১৭৮১ সালে হেস্টিংস  কলকাতায় একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন যেখানে সাধারণত প্রথমদিকে মুসলিমদের আইন কানুন, আরবি আর ফার্সি ভাষায় শিক্ষাদান করা হতো। প্রায় একদশক পর ১৭৯১ সালে ডানকান সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে সাধারণত হিন্দুদের রীতি নীতি, দর্শন আর সংস্কৃত ভাষার উপরেই জ্ঞান দান করা হতো। সে সময় ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে খুব একটা কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যায়নি।
কিন্তু ঘটনার মোড় ঘটে ১৮১৩ সালের দিকে, যখন চার্টার আইন অনুমোদন পায়। এই অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারতে একচেটিয়া ব্যবসা করার যে স্বাধীনতা ভোগ করছিলো  তা অনেকাংশেই খর্ব হয়ে যায়। ব্রিটেনের অনেক প্রাইভেট কোম্পানি এ অঞ্চলে বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়। আর ব্রিটিশরাজ এর পক্ষ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর কিছু শর্ত আরোপ করা হয় যার ভেতরে রয়েছে শিক্ষার ব্যাপারটিও। ব্রিটিশরাজ থেকে বলা হয় যে, "এখন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার উপরেও নজর রাখবে।" এমনকি প্রতি বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতের শিক্ষা ও সাহিত্য বিস্তারের জন্য এক লক্ষ রুপি দিতে হবে এমন বিধানও রাখা হয়। এরপর ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার দেখভাল করা প্রায় অনেকটাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। সে সময়ে ভারত উপমহাদেশে দুই শ্রেণির লোকের আবির্ভাব ঘটে। এক শ্রেণির লোক চাইত যে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা নিজ নিজ অঞ্চলের মাতৃভাষা, আরবি, ফার্সি আর সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমেই হোক। তাদেরকে বলা হয় প্রাচ্যবাদী যারা ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধরে রাখাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বলে ধরে নিতেন। অন্য শ্রেণীর লোকেরা হলেন পশ্চিমাবাদী  যারা কিনা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারকে প্রাধান্য দিতেন। এদের অনেকেই পাশ্চাত্যের শিক্ষা সংস্কৃতিকে প্রাচ্যের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা সংস্কৃতির তুলনায় বড় করে দেখতেন। ১৮২০ থেকে ১৮৩০ সালের দিকে এ দুই শ্রেণির বিতর্ক চরম পর্যায়ে ওঠে। প্রাচ্যবাদী ধারণার মনীষীরা দাবি করেন যে, শিক্ষা ব্যবস্থার যে অনুদান সেটি এমন স্কুল কলেজেই দান করা হোক যেখানে আরবি, ফার্সি আর সংস্কৃতের চর্চা হয়। আর পাশ্চাত্যবাদী ধ্যান ধারণার মনীষীরা দাবি করতে থাকেন যে শিক্ষা ব্যবস্থার অনুদান সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দেওয়া হোক যেখানে ইংরেজি ভাষা দিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানো হয়। দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান ব্রিটিশ এমপি লর্ড ম্যাকলে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই সদস্য ছিলেন  জোরালোভাবেই পাশ্চাত্যবাদী ধারণায় বিশ্বস্ত। ১৮৩৫ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ প্রচার করেন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উপর তার নিজস্ব মতামত।যেখানে খুব জোরালোভাবেই তিনি দাবি করেন যে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ইংরেজি ভাষা দিয়েই হবে। তার ফলশ্রুতিতে ১৮৩৫ সালেই তখনকার ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশন অ্যাক্ট’ প্রস্তাব করেন এবং ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারে ইংরেজি ভাষাকে বৈধতা দান করেন। লর্ড ম্যাকলে যে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে অন্য দেশের সংস্কৃতির তুলনায় কি পরিমাণ বড় করে দেখতেন তা তার মিনিট অন এডুকেশনে  দেখা যায়। তিনি বলেন, “ভালো একটা ইউরোপীয় লাইব্রেরীর বইয়ের একটি তাকে যে পরিমাণ সাহিত্যজ্ঞান আছে, পুরো ভারত আর আরব সাহিত্যেও সেরকম জ্ঞানের প্রাচুর্যতা নেই।”
ইংরেজি তখন হয়ে উঠে অনেক স্কুল কলেজে শিক্ষা বিস্তারের মূল ভাষা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেসব স্কুল কলেজেই অনুদান দিতে থাকে যেখানে ইংরেজি ভাষা দিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করা হয়। এ আইন ভারতের অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিদের ভেতরেই অসন্তোষের তৈরি করে। যারা প্রাচ্যবাদী ধারণায় বিশ্বাসী তাদের অনেকেই দাবি করেন যে, ইংরেজি যেহেতু ভারতবর্ষে একদম অপ্রচলিত এবং নতুন তাই আগে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করাই সমিচীন, এছাড়া  ইংরেজি শিক্ষা খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। আবার অনেকে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারকে ইতিবাচক  হিসাবে দেখতেন।
১৮৩৫ সালের পর ভারতে অনেক স্কুল কলেজ নির্মাণ করা হয় আর সে সময়ে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার যথেষ্ট  প্রসারও ঘটে। কিন্তু তারপরেও অনেক জায়গাতে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দিকে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা স্কুল কলেজে মাতৃভাষাতেই শিক্ষাদান চলতে থাকে। যদিও সেখানে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা একদম থাকতো না বললেই চলে। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উপর একটি জরীপ  চালানো হয়, যেখানে উঠে আসে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার করূণ চিত্র। প্রায় বিশ বছর পর ভারতের লোকজনের জন্য আশার বার্তা বয়ে নিয়ে আসে উডের শিক্ষা কমিশন , যা কিনা ব্রিটিশ ভারতের আধুনিক শিক্ষার ম্যাগনা-কার্টা হিসেবে প্রবর্তিত হয়। এখানে বলা হয় প্রাথমিক স্কুলগুলোতে নিজ নিজ অঞ্চলের মাতৃভাষাতেই শিক্ষাদান করা হবে, এরপর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাও শেখানো হবে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষাতে জ্ঞানদান করা হবে। চার্লস উডের এই শিক্ষা প্রস্তাবে ইংরেজির পাশাপাশি যেমন মাতৃভাষায় পাঠদানকে স্বীকৃতি  দেওয়া হয় ঠিক তেমনই নারীদের জন্য শিক্ষাকেও বৈধতা দেওয়া হয় যার ফলশ্রুতিতেই গড়ে উঠে কলকাতায় নারীদের জন্য বেথুন কলেজ। ১৮৩৫ সালের ইন্ডিয়ান এডুকেশন অ্যাক্টের পরেই চার্লস উড কমিশন যেন ভারতীয় প্রাচ্যবাদীদের জন্য আশার বাণী নিয়ে এল। চার্লস উডের এই শিক্ষা প্রস্তাব পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনামলের অন্যান্য শিক্ষা কমিশনের জন্য এক আদর্শ হয়ে ওঠে। এবং  মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা বাড়তে থাকে ঠিক সেভাবেই ইংরেজি ভাষায়ও ভারতীয়দের দক্ষতা বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের অনুদানে ভারতে গঠিত হয় আরো অনেক স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। এভাবেই জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় প্রাচ্যবাদী আর পাশ্চাত্যবাদী সমাজের সেতুবন্ধন ঘটে।
রোয়ার মিডিয়া সৌজন্যে