google-site-verification: google90012c42a1ba93ca.html

google-site-verification: google90012c42a1ba93ca.html

উপমহাদেশের স্থাপত্য কলা বিশ্ব সেরা। ২য় পর্ব

এরই মধ্যে ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবারের আপিলের কারণে সুপ্রিম কোর্ট আবার বি ভল্টের দরজা খোলার সিদ্ধান্তকে স্থগিত করে দেয় ২০১২ সালের মধ্যে এ, সি, ডি, ই এবং এফ ভল্টের দ্রব্যসামগ্রীর তালিকাকরণের কাজ শেষ হয়। ভল্ট বি, জি এবং এইচ এরপর আর খোলা হয় নি। ভল্ট বি এর মত জি এবং এইচ চিহ্নিত ভল্ট দুটিও এভাবে শত শত বছর ধরে খোলা হয় নি বলে বিশ্বাস করা হয়। মন্দিরের যে ভল্টগুলো খোলা হয়েছে সেগুলোতে রক্ষিত সম্পদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। তবে এই তালিকার সম্পূর্ণ বিবরণী প্রকাশ করা হয় নি। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে কী কী সম্পদ সেখানে ছিল তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। ভল্ট ‘সি’ তে রয়েছে ১৪৬৯ ধরণের এবং ভল্ট ‘ডি’ তে রয়েছে ৬১৭ ধরণের দ্রব্যসামগ্রী। ভল্ট ‘ই’ এবং ভল্ট ‘এফ’ এ রয়েছে ৪০ ধরণের দ্রব্যসামগ্রী। আর কেবলমাত্র ভল্ট ‘এ’ তেই রয়েছে ১ লক্ষ ২ হাজার ধরণের দ্রব্যসামগ্রী।আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এই পাঁচটি ভল্টের সম্পদের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ না করা হলেও, কমিটির সদস্য ও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী করা পত্রিকার রিপোর্ট থেকে সেখানে বিদ্যমান অজস্র ধন দৌলতের মধ্যে কিছু কিছু সম্পদের বর্ণনা জানা যায়। এই ভল্টের সম্পদের মধ্যে আছে,সাড়ে ৩ ফুট দীর্ঘ একটি স্বর্ণের বিষ্ণুমূর্তি যাতে খচিত আছে হীরা ও রুবিসহ মূল্যবান রত্ন পাথর। স্বর্ণের তৈরি একটি সিংহাসন যাতে অন্তত সাড়ে ৫ মিটার দীর্ঘ একটি মূর্তি স্থাপন করা যায়। সিংহসনের গায়ে খচিত আছে শত শত হীরা ও অন্যান্য রত্ন পাথর।সাড়ে ৫ মিটার লম্বা একটি স্বর্ণের চেইন, ৫০০ কেজি ওজনের একটি স্বর্ণের স্তুপ, ৩৬ কেজি ওজনের একটি পর্দার মত আবরণী, রত্নখচিত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বানানো ১,২০০ টি চেইন।স্বর্ণের জিনিসপত্র, নেকলেস, মুকুট, হীরা, রুবি, নীলকান্তমণি, পান্না, রত্ন পাথর ও মূল্যবান ধাতব দ্রব্যাদি ভর্তি কয়েকটি বস্তা।দেবমূর্তির শরীর আচ্ছাদনের জন্য প্রায় ৩০ কেজি ওজনের স্বর্ণের আবরণ। স্বর্ণ নির্মিত নারকেলের মালা যাতে খচিত আছে রুবি ও পান্না। ১৮ শতকের নেপোলিয়নের আমলের মুদ্রা। রোমান সাম্রাজ্যের কয়েক হাজার মুদ্রা। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের ১,৯৫০০০ টি স্বর্ণমুদ্রা যেগুলোর ওজন সব মিলিয়ে ৮০০ কেজি অন্তত ৩টি (বিভিন্ন রিপোর্টে বিভিন্ন সংখ্যার উল্লেখ আছে) সম্পূর্ণ স্বর্ণ নির্মিত আর হীরা ও অন্যান্য রত্ন খচিত রাজমুকুট। কয়েকশ স্বর্ণের চেইন। কয়েক হাজার স্বর্ণের পট ও জার। সম্পূর্ণ বিবরণী প্রকাশ করা হয় নি তাতেই এই অবস্থা, প্রকাশিত হলে আরও কী কী পাওয়া যেতে পারে তার পুরোটা অনুমান করা হয়ত কোনো মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়। শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের এই বিপুল পরিমাণ ধন সম্পত্তি কোথা থেকে এল এমন প্রশ্ন তো আছেই। বিশ্বাস করা হয়, হাজার হাজার বছর ধরে মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে দান করা সম্পদগুলোই জমা হয়ে আছে ভূগর্ভস্থ ভল্টে। ভারতের বিভিন্ন সময়ের শাসনকারী রাজপরিবারগুলো এখানে দান করেছে। মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, রোম, জেরুজালেম হতে শাসকবৃন্দ ও বণিকেরাও ভারতবর্ষে এসে মন্দিরে দান করেছে। এরপর ঔপনিবেশিক শাসনের সময়েও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে দানের সামগ্রী।অনেক গবেষকও মতামত দিয়েছেন, এই সম্পদ হাজার বছরের অর্জন। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বর্ণের খনি ছিল। সুমেরীয় আমলে মালাবার অঞ্চলে ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের কয়েকটি কেন্দ্র। সেই সূত্রে স্বর্ণ ও সম্পদ মন্দিরের কাছাকাছি স্থানেই ছিল যেখান থেকে তা মন্দিরে অর্পিত হতে পারে দেবতার নৈবদ্য হিসেবে। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে টিপু সুলতান সহ অনেকের আক্রমণের মুখে পালিয়ে এসে এই মন্দিরে আশ্রিতদের ধন সম্পদও এখানে লুকিয়ে রাখা হত নিরাপদ জায়গা হিসেবে। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র নাগাস্বামী এ ব্যাপারে জানান, কেরালার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে নৈবদ্য হিসেবে ধন সম্পদ দেয়ার রেকর্ড পাওয়া যায় ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল থেকে। মহারাণী গৌরী লক্ষ্মী বাঈ এর শাসনামলে কেরালার কয়েকশ মন্দিরের অব্যবস্থাপনার কারণে এগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। এসব মন্দির থেকে অনেক স্বর্ণালংকার সরিয়ে নিয়ে রাখা হয় শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে। ১৭৭৬ থেকে ১৭৯২ সাল পর্যন্ত ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যে আশ্রয় নেয় প্রায় বারো জনের মত হিন্দু রাজা যারা টিপু সুলতানের বাহিনীর কাছে পরাজিত হওয়ার ভয়ে পালিয়েছিলেন। পালানোর সময় তারা যত পারেন ধন সম্পদ নিয়ে এসেছিলেন এবং দান করেছিলেন পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে। ব্রিটিশদের নিকট টিপু সুলতানের পরাজয়ের পর এই রাজারা তাদের এলাকায় ফিরে যাবার পরেও তারা এবং তাদের বংশধরেরা এই মন্দিরে দান করেছিলেন। এছাড়া মন্দিরের ভক্ত ধনী ব্যবসায়ী ও জমিদারদের দান তো ছিলই। প্রাচীন মালায়লাম ও তামিল ইতিহাসের এক বিশাল ভাণ্ডার হল ‘কজনপত্র’ বা তালপাতায় লিখিত ইতিহাস। এমন ৩,০০০ টি বান্ডেল আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে, যার প্রতিটি বান্ডেলে রয়েছে কয়েক হাজার তালপাতা। সেখানে লিখিত আছে হাজার বছর ধরে শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে স্বর্ণ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি নৈবদ্য প্রদান করার তথ্য। এর মাত্র অল্প কিছু পাতা এখনো গবেষণা করা হয়েছে। বাকিগুলো থেকে তথ্য উদ্ধার করা গেলে হয়ত জানা যাবে মন্দিরের বিপুল ধনভাণ্ডারের উৎসের ইতিহাস। ১৯৩৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এমিলি গিলিক্রিস্ট হ্যাচ নামক একজন লেখিকার ‘Travancore: A Guide Book for the Visitor’ বইয়ে উল্লেখ আছে, ১৯৩১ সালে রাজা চিথিরা থিরুনাল বলরাম ভার্মার আদেশে ‘বি’ ভল্টের একেবারে বাইরের অংশটির দরজা একবার খোলা হয়েছিল। তিনি আরও লিখেন, এর দুই যুগ আগে ১৯০৮ সালে রাজ্যের অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় এই ভল্টটি খুলে সেখানকার সম্পদ কাজে লাগানোর কথা চিন্তা করা হয়েছিল। একদল লোক আলো হাতে ভল্টে প্রবেশের চেষ্টা করে। এরপর কোবরা বা গোখরো সাপের আক্রমণে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য তারা সেখান থেকে পালিয়ে আসে।
যাই হোক, আদালতের নিযুক্ত ‘এমিকাস কিউরি’ বা ‘আদালতের বন্ধু’ হিসেবে আইনজীবী গোপাল সুব্রামানিয়াম ২০১৪ সালে তার প্রদত্ত রিপোর্টে যথাযথ ধর্মীয় রীতি পালনের পর এই ‘বি’ ভল্টটি আবার খোলার পরামর্শ দেন। উপরে যে ধনসম্পদের একাংশের কিছু বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেগুলো ছিল তালিকাকৃত পাঁচটি ভল্টের সম্পদের অংশ। এই পাঁচটি ভল্টের মোট সম্পদের যেগুলোর আর্থিক মূল্য প্রায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার। ‘বি’ ভল্টে কী এমন আছে যার জন্য এত দুর্ভেদ্য সেই ভল্ট? ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবারের ১৮৮০ সালের ইতিহাস থেকে একটি নির্ভরযোগ্য তথ্য জানা যায় ‘বি’ ভল্টের সম্পদের ব্যাপারে। সে তথ্য অনুসারে, সেই আমলে এই ভল্ট এর সম্পদের আর্থিক মূল্য ছিল ১২ হাজার কোটি রুপি। বর্তমানে স্বর্ণের দাম এবং মুদ্রাস্ফীতি হিসেব করে সেই মূল্য কততে দাঁড়িয়েছে জানতে চান? ৫০ ট্রিলিয়ন বা ৫০ লক্ষ কোটি রুপি, আর আন্তর্জাতিক হিসেবে, ১ ট্রিলিয়ন বা ১ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার! বাংলাদেশের টাকায় কত হয় সেটা আপনিই হিসেব করুন। আর এসব সম্পদের সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক মূল্য তো মানুষের হিসেবের বাইরে। ইতিহাসের কিছু সম্পদের হিসেব দিলে হয়ত এই মন্দিরের পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী প্রতিষ্ঠানের খেতাবটা বোঝা যাবে। সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলের মুঘল রাজকোষের সবচেয়ে রমরমা সময়ে সেখানে ছিল সাত টন স্বর্ণ, প্রায় ৩৭ কেজি অপরিশোধিত হীরা, প্রায় ৪৫ কেজি রুবি ও ৪৫ কেজি পান্না আর প্রায় ২৭২ কেজি মুক্তা! আজকের যুগের হিসেব অনুসারে, মুঘল আমলের জিডিপি সবচেয়ে বেশি ছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে, প্রায় ৯ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ভাবুন তাহলে, সেটাও এই মন্দিরের সম্পদের তুলনায় কিছুই ছিল না, বিখ্যাত ব্রিটিশ ক্রাউন জুয়েলের মূল্যের হিসেব তো বাদই দিলাম। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসের কোনো সময়ের কোনো ধনভাণ্ডারের আর্থিক মূল্য শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের সম্পদের সমান নয়। এই বিশাল সম্পদের বিবরণী লোকচক্ষুর সামনে চলে আসার পর এই মন্দিরের ধন সম্পদের মালিকানা কার তা নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা চলছে সারা ভারত জুড়ে তখন ভারতের প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। ঠিক সে সময় কেরালা রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উমেন চাণ্ডি বলেন, “এই স্বর্ণ দেয়া হয়েছে দেবতার নৈবদ্য হিসেবে। এর মালিকানা মন্দিরের। সরকার মন্দিরের সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা করবে ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবার, মন্দির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও মন্দিরের পুরোহিতদের সাথে আলোচনা করে।” এই সম্পদ মন্দিরের মালিকানার কিনা সেই বিতর্কের এক পর্যায়ে প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ভি আর কৃষ্ণ আয়ার বলেন, “দেবতার সম্পদের মালিকানা জনগণের, রাজার নয়। হিন্দু কিংবা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর এই সম্পদের মালিক এমন বলাটা অর্থহীন। ধনীরা নয় বরং দরিদ্র এবং যাদের অর্থের প্রয়োজন আছে তারা যাতে এই সম্পদ থেকে উপকৃত হয় তেমন ব্যবস্থা করা দরকার। ইতিহাসের কত চড়াই উৎরাই সময়ে হয়ত কোন বিপদ থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে কত বিশ্বাসী মানুষ দেবতার চরণে সম্পদ অর্পণ করেছিলেন। কেউবা হয়ত তার সমৃদ্ধি আরও স্থায়ী করার জন্য, কেউবা কেবলই ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে তাদের সম্পদ দিয়েছিলেন মন্দিরের ভাণ্ডারে। সেই সমস্ত সম্পদ নিয়ে আজকের এই বিপুল ধনরাশি। কিন্তু এই সম্পদ যদি মানুষের কাজে না লাগে তাহলে তার এত এত আর্থিক মূল্যের সত্যিকারের ‘মূল্য’টাই বা কী? মানুষের সমাজে অমানবিক জীবন বজায় রেখে কি উপাসনালয়ের ধনভাণ্ডারের নিরাপত্তা বিধান চলতে পারে? সাম্যবাদী কবিতায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চারণ করেছিলেন, “মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।” মন্দির হোক, কিংবা মসজিদ, মানুষের হৃদয়ের দাবি শোনার জন্যই তো ধর্ম!সৌজন্যে রোর বাংলা