Adsense

সতিদাহ প্রথা এক অজানা ইতিহাস

সৌজন্যে তাজুল ইসলাম 
পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়টি বর্বর ও অমানবিক প্রথার কথা জানা যায়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারতবর্ষের সনাতন সমাজে এক সময়কার প্রচলিত ‘সতীদাহ’ রীতি। ব্রাক্ষণদের প্রবর্তিত এই প্রথায়, কোনও নারীর স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে জোর করে স্বামীর মরদেহের সাথে চিতায় তুলে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়া হতো। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়, প্রথাটি বন্ধ হয়েছিল রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায়। কিন্তু আসল সত্যিটা হলো, অমানবিক এই প্রথা নির্মূলের পেছনে মূখ্য অবদান ছিলো ভারতবর্ষের মুসলিমদের। ঈসা মসিহের (আ.) জন্মের চারশ বছর আগে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই ভারতবর্ষে এই প্রথার প্রচলন ছিলো। প্রাচীন সতীদাহ প্রথার উদাহারণ পাওয়া যায় অন্তর্লিখিত স্মারক পাথরগুলিতে। সবচেয়ে প্রাচীন স্মারক পাথর পাওয়া যায় ভারতের মধ্যপ্রদেশে। কিন্তু সব চাইতে বড় আকারের সংগ্রহ পাওয়া যায় রাজস্থানে। এই স্মারক পাথরগুলিকে ‘সতীস্মারক’ বলা হতো, যা ছিলো পূজণীয় বস্তুও। ভারতবর্ষে মুসলিমদের আগমনের সাথে সাথেই সতীদাহ প্রথা নির্মূলের চিন্তাভাবনা শুরু হয় ইসলামী আলেমদের মাধ্যমে। মুসলিম শাসকরা আইনানুগ ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। আর তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় ইতিহাসবেত্তাদের লেখনীতেও।
১. সতীদাহ প্রথা বন্ধের প্রথম সরকারি প্রচেষ্টা মুসলিমরা করেছিলেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক সর্বপ্রথম এই প্রথা বন্ধের চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন।
২. মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যারা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হুমায়ূন স্থানীয় হিন্দুদের প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন।
৩. অনেক সময় মুঘল শাসন থেকে বিধবা মহিলাদের পেনশন বা উপহার দেয়া হতো সতীদাহ না করার জন্য।
৪. শিশুদের এই প্রথা থেকে রক্ষা করা হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহানের সময় নিয়ম ছিল কোনো অবস্থাতেই যেসব মহিলাদের সন্তান আছে তাদের দাহ হতে দেয়া হবে না।
৫. সব থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয় সম্রাট আলমগীরের সময়। ১৬৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি রুল জারি করেন, যেকোনও পরিস্থিতিতে মুঘল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দেশের কোথাও সতীদাহ ঘটতে সরকারি অনুমতি দেয়া হবে না। ইউরোপীয় পর্যটকদের বর্ণনা অনুযায়ী সম্রাট আলমগীরের শাসনামলের শেষের দিকে সতীদাহ প্রথা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু হিন্দু শাসকদের স্ত্রীরা ব্যতীত। মুসলিম শাসকরা প্রথম দিকে ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্য ধর্মে হস্তক্ষেপ করার ঝুঁকি না নিলেও ইসলামের মানবতাবাদী দর্শন প্রচার ও প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন। তখন ভারতবর্ষের মুসলিমদের ভেতর শিয়া-সুন্নি মতাবলম্বীদের মধ্যে কোনও বিরোধ ছিলো না বলে চার বর্ণে বিভক্ত হিন্দুদের চেয়ে মুসলিমদের শক্তি বাড়ছিলো। উভয় মাজহাবের আলেমরাই নিজেদের মতপার্থক্য এড়িয়ে অমুসলিমদের কাছে ইসলামের সুমহান শিক্ষা তুলে ধরতেন। এর ফলে বর্ণপ্রথার শিকার দলিত শ্রেণির হাজারো মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসে ভারতজয়ী মুসলিমদের কাছে নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা পায়, তেমনি সতীদাহের ভুক্তভোগী হাজার হাজার হিন্দু নারীদের জীবনও রক্ষা পায়।
মুসলিম শাসনের অধীনে ইসলামের শিক্ষায় হিন্দুধর্মের সংস্কারবাদী ধারার সৃষ্টি করে। হিন্দুধর্ম থেকে বেরিয়ে গুরু নানক ও মহাবীর প্রবর্তন করেছিলেন শিখ ও জৈন ধর্ম, যেখানে সতীদাহ প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ প্রথম দিকে ভারতের সনাতনদের ধর্মীয় বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদে পরোক্ষ অবদান রেখেছে মুসলিমরা। পরবর্তীতে প্রথমবারের মতো এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ নেন সুলতান মুহাম্মদ তুঘলক। এরপর একে একে সম্রাট হুমায়ূন, আকবর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেব সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেন।
রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রহিত করতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা ছিলো আরও অনেক পরে, ব্রিটিশ আমলে। অবশ্য হিন্দু নারীদের ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের প্রবণতা ঠেকানোই এর মূল কারণ ছিলো বলে মনে করেন অনেকে।

No comments: